বাংলাদেশে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ব্যবসা করার জন্য অনুমোদিত কোম্পানী কয়টি ও তাদের নামগুলো জানতে চান?
এমএলএম ট্রি--০১ |
অভয়ার ধারণাঃ
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) বা বহুজাত বিশিষ্ট পণ্য বাজারজাত পদ্ধতি বাংলাদেশে নতুন হলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে অর্ধ শতকের বেশি সময় আগে এটি চালু হয়েছিল। নেটওয়ার্ক মার্কেটিং, ডিরেক্ট সেলিং ও রেফারেন্স মার্কেটিং হিসাবেও এটি পরিচিত। মাল্টিলেভেল মার্কেটিং মূলত ডিস্ট্রিবিউটরদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা বিক্রি করার একটি প্রক্রিয়া।
আধুনিক অভিধানে এর সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয় :(মাল্টি লেভেল মর্কেটিং যা এএলএম বা নেটওয়ার্ক মার্কেটিং নামেও পরিচিত, তা হল একটা ব্যবসায় পদ্ধতি যেখানে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করা হয় … আর তা মূলত ডিস্ট্রিবিউটরদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা বিক্রি করার একটি প্রক্রিয়া।
এ প্রক্রিয়ায় আপলাইন ও ডাউনলাইন নামে বহু স্তরের (Multi level) ডিস্ট্রিবিউটর তৈরি হয়। ডাউনলাইনের কোনো ব্যক্তি কর্তৃক বিক্রিত পণ্যদ্রব্যের একটি কমিশন আপলাইনের ডিস্ট্রিবিউটররা পেয়ে থাকে। একে সংক্ষেপে MLM বলা হয়। যেসব দেশে এ ব্যবসা প্রচলিত রয়েছে সেখানে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো আইন না থাকায় তা এখনও চালু রয়েছে।
ব্যক্তিস্বাধীনতার সর্বোচ্চ বিকাশের কারণে অনেকাংশেই ব্যবসাটি বহাল রয়েছে। কিন্তু সেসব দেশের সচেতন মহল প্রতিনিয়তই জনগণকে এ ব্যবসায় সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত করছে।
কোম্পানিগুলো হচ্ছে কপোতাক্ষ মার্কেটিং কোম্পানি, সিএমএস ইন্টারন্যাশনাল, বিডিলিংক সিস্টেমস, সানল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্রোপার্টিজ, শাহানা এক্সপ্রেস, আল-বারাত কমিউনিকেশনস, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম, ইন্টারমিনেট সার্ভিসেস, ম্যাজিকবাংলা টেলিমিডিয়া, শেখ ব্রাদার্স শিপিং করপোরেশন, লাইফটাইম কনসেপ্ট, সেলফ ড্রিম, স্পাইডারস নেট ওয়ার্ল্ড ট্রেডার্স লি., ইন্টারন্যাশনাল ইনফরমেশন টেকনোলজি সলিউশন লি., সরকার অর্গানিক শ্রিম্প সার্ভিস সেন্টার লি., উইস্টার্ন স্টিচ (বিডি) লি., সুইস ডিসিহাইফেলি ফ্যাশন লি., ফ্যামিলি মার্ট সুপারশপ লি., অ্যাপার্টমেন্ট মার্কেটিং লি., কৃষ্ণচূড়া লি., অ্যাসুরেন্স (বিডি), টার্গেট নেটওয়ার্ক মার্কেটিং, পারফেক্ট গেটওয়ে বাংলাদেশ, পেন্টা টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, আইডিয়া মার্কেটিং করপোরেশন, শেফা টপস ও গ্লোবাল ২০২০ মার্কেটিং।
এমএলএম নিয়ে জনপ্রিয় ওয়েব সাইট “টেকটিউন” এর দেওয়া পোস্টটি নিন্মরুপঃ
এমএলএম ট্রি-০২ |
প্রতিবেদন:বর্তমানে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওয়েবসাইট ভিত্তিক বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানি MLM (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) পদ্ধতিতে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে, এরা মানুষকে অল্প সময়ে অধিক লাভের উপায় দেখাচ্ছে, যার ফলে ব্যপক সংখ্যক মানুষ এইসব ব্যবসায় যোগ দিচ্ছে এবং অপরকে যোগ দিতে উৎসাহিত করছে। দেশের ভেতরেও একসময় এ ধরণের বিভিন্ন কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনা করলেও বর্তমানে একটি ছাড়া বাকি গুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়না।
MLM বিজনেসের মূলমন্ত্র হচ্ছে মাছের তেলে মাছ ভাজা, অথবা বলতে পারেন গরু মেরে জুতো দান। অর্থাৎ আপনাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমান টাকা দিয়ে এদের সদস্য হতে হবে, এরপর আপনি যদি তাদেরকে আপনার মত আরো সদস্য যোগার করে দিতে পারেন তাহলে আপনি লভ্যাংশ বা কমিশন পাবেন। এরকম একটি পরিচিত সাইটের উদাহরণ দেই। এই সাইটটিতে আপনাকে ১৪৯ ইউরো দিয়ে মেম্বার হতে হবে, এরপর আপনি যদি তাদেরকে আপনার মত একজন মেম্বার যোগার করে দিতে পারেন তাহলে আপনি পাবেন ১৫ ইউরো। অর্থাৎ আপনার ইনভেস্টের ১৪৯ ইউরো উঠাতেই আপনাকে ১০ জন মেম্বার যোগার করতে হবে। অর্থাৎ ১০ জন লোকের কাছ থেকে ১৪৯০ ইউরো নিয়ে তাদেরকে দিলে তারা আপনাকে আপনার ইনভেস্টের ১৪৯ ইউরো ফেরত দেবে। আর এ সাইট থেকে লভ্যাংশ বা কমিশন পেতে হলে কি পরিমান ইউরো তাদের দিতে হবে, তার হিসাব নিজেরাই করে নিন। তবে এসব কোম্পানি তাদের এই সহজ হিসাব লুকানোর জন্য এর সাথে বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণী নিয়ম, পদ্ধতি, শাখা প্রশাখা অথবা পন্য বিক্রির শর্ত, ডিলারশিপ, মেম্বারশিপ দিয়ে থাকে।
আসল কথা হচ্ছে, বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিজেদের ডলার, ইউরোর রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য MLM পদ্ধতিকে বেঁছে নিয়েছে, আর তাদের এই পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য তারা আমাদের মত (উন্নয়নশীল ও শিক্ষিতের হার কম) দেশগুলোকে তাদের শিকারে পরিনত করেছে। আর এই কাজের প্রচার ও প্রসারের জন্য তারা এসব দেশের কিছু ব্যক্তিকে দালাল হিসেবে টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে, যারা এসব কোম্পানির গুণগান ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মানুষের কাছে তুলে ধরছে। আমরাও আমাদের তাৎক্ষনিক লাভ আর ব্যক্তি স্বার্থের জন্য কিছু চিন্তা না করেই এইসব ব্যবসায় নিজেরা ঝাঁপিয়ে পরছি এবং নিজের আত্মীয় সজন, বন্ধু বান্ধব, পরিচিত অপরিচিত সবাইকে এতে যোগ দিতে বলছি। কিন্তু একটুও ভেবে দেখছিনা যে, আমাদের একজনের ইনভেস্টের ১৪৯ ইউরো (প্রায় পনর হাজার টাকা) উঠাতেই যদি ১৪৯০ ইউরো (প্রায় দেড় লাখ টাকা) বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে হয়, তাহলে আমাদের মতই দেশের আরও শত শত কিংবা হাজার হাজার সদস্য যদি তাদের ইনভেস্ট অথবা কমিশন উঠাতে চায় তহলে কত লক্ষ কোটি ইউরো বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে হবে (হয়ত দিয়েছিও)। আপনাদের অনেকেই হয়ত কয়েকদিন আগে বিভিন্ন পত্রিকায় দেশের ইউরো রিজার্ভ সঙ্কটের বিষয়ে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদটি পড়ে থাকবেন।
আপানার হয়তো জানেন যে, বাংলাদেশের ডলার, ইউরো তথা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংগৃহীত হয় প্রধানত দুই ভাবে। যার একটি হচ্ছে, বাংলাদেশের উৎপাদিত বিভিন্ন পন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানির মাধ্যমে, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে “ফরেন রেমিটেন্স” অর্থাৎ বিভিন্ন দেশে কর্মরত আমাদের প্রবাসী ভাইদের কষ্টার্জিত উপার্জনের মাধ্যমে, যা তারা দেশে পাঠিয়ে থাকেন। আর আমরা তাদের এই কষ্টার্জিত ডলার, ইউরো নিজেদের সামান্য লাভের আশায় বুঝে অথবা না বুঝে বিদেশীদের হাতে তুলে দিচ্ছি। বিদেশীরাও এই বিপুল অংকের ইউরো, ডলার হাতিয়ে নিয়ে উক্ত ইউরো, ডলার থকেই সামান্য কিছু লভ্যাংশ আমাদেরকে দিয়ে মাছের তেলে মাছ ভেজে নিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা আমাদের ব্যক্তিস্বার্থ, সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিক্ষা ও চিন্তার দৈন্যতার কারনে বিদেশীদের এই সহজ শুভঙ্করের ফাঁকিও ধরতে পারছিনা। তাই সবার কাছে আমার সবিনয় অনুরোধ, নিজেদের ক্ষনিকের লাভের জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করা থেকে আমরা বিরত হই। আর তা নাহলে, এর ভয়াবহতার শিকার আমাদের সবাইকেই হতে হবে, প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে।
একটি উদাহরণঃ মনে করুন যে, বাংলাদেশের অন্যতম MLM কোম্পানিটিতে বাংলাদেশের সব মানুষ সদস্য হয়ে গেল। MLM কোম্পানি আর তাদের সদস্যদের জন্য খুবই আনন্দের সংবাদ তাই না? কিন্তু একটু ভেবে দেখুন, একদম শেষে যারা সদস্য হবে, তারা রেফারেল বা সদস্য সংগ্রহ করবে কোথার থেকে, কেননা তাদের আগেই বাংলাদেশের সব মানুষ MLM কোম্পানির সদস্য হয়ে গেছে। অতএব, তারা সদস্যও সংগ্রহ করতে পারবেনা আর কমিশনও পাবেনা। এভাবে যদি সারা পৃথিবীর মানুষকেও উদাহরন হিসেবে ধরা হয় তাহলেও দেখবেন যে, যারা সব শেষে MLM কোম্পানির সদস্য হবে তারা তাদের কমিশন পাবার জন্য আর কোন রেফারেল বা সদস্য খুঁজে পাবেনা। কারন তাদের আগেই সারা পৃথিবীর মানুষ এর সদস্য হয়ে গেছে। আর তাই মনে রাখবেন, MLM বা পিরামিড বিজনেসে শেষের দিকে যারা ঢুকবেন তাদের MLM এর অংকের নিয়মে ক্ষতিগ্রস্থ হতেই হবে। আর ইসলামে MLM নিষিদ্ধ হবার জন্য এই কারণটাই যথেষ্ট। আর এ জন্যই MLM বিজনেসকে পিরামিড বিজনেসও বলা হয়, অর্থাৎ অপরের মাথায় পা দিয়ে নিজে উন্নতির শিখরে ওঠো।
পরিশেষে আমাদের এলাকার এক বুয়ার MLM ব্যবসা ও এর পরিণতির কাহিনী বলে শেষ করছি। এই বুয়া বিভিন্ন বাসা ও মেসে কাজ করত আর তার স্বামী ছিল রিকশা চালক। বুয়া এবং তার স্বামী তাদের বিপদ আপদের কথা ভেবে একটু একটু করে কিছু টাকা সঞ্চয় করেছিল। তো, বুয়া যেসব মেসে কাজ করত তার একটি মেসে থাকতো বাংলাদেশের অন্যতম একটি MLM কোম্পানির একজন করিৎকর্মা সদস্য। সে মাঝে মাঝেই বুয়াকে অল্প পুঁজি ও স্বল্প সময়ে বিশাল বড়লোক হবার বর্ণিল স্বপ্ন দেখাত, যেভাবে MLM এর সদস্যরা সুযোগ পেলেই সবাইকে এই স্বপ্ন দেখায়। তার যাদুকরি কথার প্রভাবে বুয়া তার ও তার স্বামীর সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে উক্ত MLM কোম্পানির সদস্য হল। কিন্তু বুয়াতো আর কোম্পানির ডান বামের হিসাবও বোঝে না, আর সদস্যও সংগ্রহ করতে পারেনা। কারন সে তার সীমিত শিক্ষা আর বুঝ দিয়ে মানুষকে ঐ করিৎকর্মা ! MLM সদস্যের মত বুঝাতেও পারেনা আর স্বপ্নও দেখাতে পারেনা, তাই তার অল্প সময়ে বড়লোক হবার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যায়। এসব দেখে ও শুনে তার রিকশা চালক স্বামী তাকে তালাক দিয়ে চলে যায়। এই ফাঁকে ঐ করিৎকর্মা ! MLM সদস্যও উক্ত মেস ছেড়ে চলে যায়। এর ফলাফল যা দাঁড়ালো তা হচ্ছে, MLM কোম্পানি পেল বুয়ার সারা জীবনের সঞ্চিত টাকা, ঐ করিৎকর্মা ! MLM সদস্য পেল তার কমিশন, আর ঐ বুয়া পেল তালাক আর সব হারানোর হাহাকার।
আশাকরি টিউন টি পড়ে আমরা নিজেরা সচেতন হবো এবং অপরকে সচেতন করব। আর মুসলিম ভাইদের বলছি, MLM পদ্ধতিতে ব্যবসা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আলেমদের একটি দলিল ভিত্তিক লেখা (বাংলা অনুবাদ সহ) আমার সংগ্রহে আছে।
এ সম্পর্কে উলামায়ে কেরামদের ওয়েবসাইট ’আলকাউসার’ এর একটা দীর্ঘ প্রতিবেদন পড়ুনঃ
উলামায়ে কেরামের অনুরোধে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ের উপর মুহাযারার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিগত ৬-১২-১৪৩২ হি. মোতাবেক ৩-১১-২০১১ ঈ., বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় মাল্টিলেভেল মার্কেটিং সম্পর্কে একটি মুহাযারা। বিভিন্ন মাদরাসার ফিকহ-ফতোয়া বিভাগে অধ্যয়নরত তালিবানে ইলম ও দায়িত্বশীলদের উদ্দেশে মুহাযারাটি পেশ করেন মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার মুদীর, মারকাযের ফতোয়া বিভাগ ও আততাখাসসুস ফিল ফিকহি ওয়াল ইফতা’র রঈস মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব।
তাঁর নযরে ছানীর পর আলোচনাটি আলকাউসারে পত্রস্থ করা হচ্ছে। এ সংখ্যায় প্রথম কিস্তি ছাপা হল। মুসাজজিল থেকে আলোচনাটি পত্রস্থ করেছেন : মাওলানা আবদুল্লাহ মাসুম। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে উপকৃত করুন। আমীন।
হামদ ও সালাতের পর
মারকাযুদ দাওয়াহ কর্তৃপক্ষ ফিকহুল মুআমালাত বিষয়ে কিছু আলোচনা ও প্রশ্ন-উত্তর এর আয়োজন করেছেন। দীর্ঘদিন থেকেই আবেদন ও অনুরোধ করা হচ্ছিল, এ বিষয়ে বড় আকারে
মুহাযারা ও প্রশিক্ষণ মজলিস করার। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে এতদিন তা হয়ে উঠেনি। ধীরে ধীরে দাবিটা যখন ব্যাপক হল এবং এর প্রয়োজনীয়তাও বাড়ল তখন সিদ্ধান্ত হল, আপাতত স্বল্প পরিসরে শুরু করা হোক এবং মুহাযারা আকারে হোক। আল্লাহ তাআলা চাহে তো বড়ভাবে, তাদরীবী আকারে পরে আয়োজন করার চেষ্টা করা হবে। তাই ব্যাপক জানাজানি করা হয়নি এবং ব্যাপক প্রস্ত্ততি ছাড়াই আজকের মজলিসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা ঠিক হাকীকী মুহাযারা বলতে যা বুঝায় তা-ই।
কথা ছিল প্রথম দিকে তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার : ১. মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ২. শেয়ারবাজার ও ৩. মাল্টি পারপাস সোসাইটি ও এ জাতীয় সংস্থা।
একদিনের সামান্য সময়ে এ তিন বিষয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই যে কোনো একটি বিষয়কেই বেছে নিতে হবে। অনেকে বলেছেন, এমএলএম দিয়ে শুরু করতে। তাই আমরা এ বিষয় দিয়েই আলোচনা শুরু করছি।
এমএলএম-এর ইতিহাস
এমএলএম-এর ইতিহাস অনেক বেশি দিনের নয়। অর্ধশতাব্দীর কিছু বেশি এর বয়স। ইনসাইক্লোপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ১৯৪৫ সাল থেকে এর যাত্রা শুরু। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমএলএম ভিত্তিক কোম্পানি চালু হয়েছে। এর অধিকাংশগুলোই একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর বন্ধ হয়ে গেছে। আমেরিকাসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই আইন করে বন্ধ করা হয়েছে বহু এমএলএম কোম্পানিকে। কিন্তু এতে থেমে যায়নি এ কারবারের আগ্রহী ব্যক্তিরা।
ঠিক এখন আমাদের দেশে এমএলএম যেরূপে প্রচলিত শুরুতে এমন ছিল না। তবে এর পুরান পদ্ধতিটা ঐ নামে আমাদের দেশে না থাকলেও ঐ পদ্ধতিটা ভিন্নভাবে প্রচলিত ছিল। আপনাদের কারো কারো হয়ত মনে আছে, এ দেশে একসময় পোস্ট অফিসগুলোতে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে-বেনামে অপরিচিত জায়গা থেকে মানি অর্ডারে টাকা আসার হিড়িক পড়েছিল। প্রাপককে লিখে দেওয়া হত দুটি ঠিকানা এবং ঐ ঠিকানাগুলোতে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাঠানোর জন্য বলে দেওয়া হত। যার মাধ্যমে বড় লাভ পাওয়ার আশ্বাস দেওয়া হত। প্রতারণার এই ফাঁদ ব্যাপক হওয়ার পর কর্তৃক্ষের টনক নড়ে এবং ধীরে ধীরে তা বন্ধ হয়। যাই হোক, আমেরিকাতেও এর কাছাকাছি একটি কারবার পিরামিড স্কীম নামে শুরু হয়েছিল। এটিই এমএলএম-এর সনাতনি পদ্ধতি।
পিরামিড স্কীম-এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ
টাকা দিয়ে সদস্যপদ খরিদ করা। একজন লোক নির্ধারিত ফী দিয়ে সদস্য হবে। এরপর সে আরো সদস্য বানাবে। এভাবে নেট পদ্ধতিতে এগিয়ে যাবে এবং উপরওয়ালারা নীচেওয়ালাদের থেকে কমিশন পাবে। পিরামিড স্কীম কিছুদিন চলার পর স্বাভাবিক নিয়মেই তা বন্ধ হয়ে যায়। যখন মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে তখন পিরামিড স্কীম আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমেরিকাতে আইন হয়েছে। আরো কিছু দেশেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এরপরও তারা থেমে থাকেনি। নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। এমএলএম-এর বর্তমান পদ্ধতিটি (পণ্য বা সেবার পদ্ধতি) শুরু হয়েছে বেশিদিন হয়নি। এর বয়স মোটামুটি হয়ত দুই দশকের বেশি হবে না।
এদেশে যখন তারা আসে তখন মারকাযুদ দাওয়াহ প্রতিষ্ঠার সম্ভবত তৃতীয় বছর। বেকার ও স্বল্প আয়ের লোকদের মধ্যে হিড়িক পড়ে গিয়েছিল এতে অংশগ্রহণ করার। রাতারাতি বড় লোক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল তারা। কিছু কিছু অবুঝ মাদরাসাছাত্র ও দ্বীনদার শ্রেণীর লোকও এ মিছিলে যোগ দিয়েছিল। এমনি পরিস্থিতিতে মারকাযুদ দাওয়াহসহ অন্যান্য দারুল ইফতাগুলোতে ব্যাপকভাবে মানুষ এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা শুরু করে।
বিষয়টি ছিল তখন নতুন। এ পদ্ধতিতে পরিচালিত কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক পলিসি বুঝানোর জন্য বিভিন্ন সেমিনার ও লেকচারের আয়োজন করত। মানুষ তাতে ৫/-টাকা ফি দিয়ে অংশগ্রহণ করত। লেকচার ফি ৫/-টাকা। গুলশান এলাকায় তাদের বক্তৃতা হত। সেখানে এ কারবারের উপকারিতা এবং এতে অংশগ্রহণ করে কিভাবে অল্প দিনে অনেক টাকার মালিক হওয়া যায় তা বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বুঝানো হত।
শুরুতে টংচেং ও জিজিয়ান এ দুটি কোম্পানি বেশ চলেছিল। টংচেং পানি বিশুদ্ধকরণ মেশিন বিক্রি করত। তারা যে মেশিন বিক্রি করত ঐ মানের মেশিন বাইরে অর্ধেক দামে পাওয়া যেত। তবে তাদের মেশিনটি ছিল ভিন্ন নাম ও ভিন্ন ব্র্যান্ডের। যা বাজারে নেই। এটি এমএলএম কোম্পানির একটি বিশেষ ব্যবসায়িক পলিসি। তারা এমন ব্র্যান্ডের পণ্য আনে, যা বাজারে থাকে না। ফলে সাধারণ মানুষ এই নামে আর দামের তুলনা করতে পারে না।
আমাকে প্রথম যখন এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তখন শুনেই বলেছিলাম, ব্যবসার যে চক্করটা শুনলাম শরীয়তে এ ধরনের ব্যবসা বৈধ হওয়ার কথা নয়। তবে আমি সিদ্ধান্তও দিচ্ছি না। এটি এককভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো নয়। অন্যান্য দারুল ইফতার সাথে কথা বলে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এরপর ঢাকাস্থ বেফাকের মুফতী বোর্ডের নিকট এটি পেশ করা হল। তারা দীর্ঘদিন আলোচনা-পর্যালোচনার পর তাহকীক করে দলিলভিত্তিক সিদ্ধান্ত দিলেন যে, এটি বৈধ নয়। অতপর ফতোয়াটি পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেশের অন্যান্য জেলার বড় বড় মাদরাসাগুলোতে। এবং প্রায় সকল বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাতে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর আসে।
ফতোয়া আসার কিছুদিনের মধ্যে কোম্পানি দুটি (টংচেং ও জিজিয়ান) বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তারা বসে থাকেনি। আবার ভিন্ন নামে শুরু করার জন্য চেষ্টা আরম্ভ করে।
তখন ফতোয়ার প্রভাব এখনের চেয়ে ভালো ছিল। ফলে এমএলএম কারবারিগণ বাধ্য হয়ে মুফতীদের নিকট ও বিভিন্ন দারুল ইফতায় ছুটে এসেছিলেন।
তারা বিভিন্ন লোক মারফত খবর পাঠিয়েছিলেন, আলেমগণ রাজি হলে সোনাগাঁও হোটেলে তারা আলোচনার আয়োজন করবেন। তারা হয়ত ভেবেছিল, ৫ তারকা হোটেলের চাকচিক্য দেখে হুজুরররা ফতোয়া বাতিল করে ফেলবেন। আমি তখন বলেছি, দুনিয়াদাররা আলেমদেরকে কিনে ফেলতে চায়। আলেমদের দায়িত্ব তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া এবং মুখের উপর তিরস্কার করা।
আমাকে যখন একথা শুনানো হয়েছিল তখন তাদের মুখের উপর বলেছিলাম, আমরা চাটাইয়ে বসে যে মাসআলা দিয়েছি সোনারগাঁও হোটেলেও মাসআলা তাই থাকবে। জায়গার চাকচিক্যে মাসআলার কোনো পরিবর্তন হবে না। আপনাদের কিছু প্রয়োজন হলে, আমাদের ফতোয়ার উপর কোনো কথা থাকলে আপনারা আমাদের অনাড়ম্বর দফতরে আসুন, আমরা কথা বলতে প্রস্ত্তত। সোনারগাঁও যেতে হবে কেন? এরপর তারা ঠিকই আমাদের চাটাইয়ের দফতরে এসেছিলেন এবং দুঃখও প্রকাশ করেছেন। ফতোয়া নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য ছিল না তবে তারা বিকল্প চেয়েছেন। আমরা তখন যা বলার বলেছি। এ বিষয়ে ইনশাআল্লাহ পরে আলোচনায় আসছি।
মোটকথা, ফতোয়া আসার কারণে কোম্পানি দুটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তারা থেমে থাকেনি। অন্য নামে আরো কোম্পানি চালু করেছে। এই লাইনে আরো নতুন নতুন লোকের আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই একই জিনিস। শুধু নামের পরিবর্তন। এবং আগের কোম্পানিগুলোতে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই এ কোম্পানিগুলোতে যোগ দিয়েছেন। এটি এমএলএম কোম্পানির স্বভাবজাত ধর্ম। একটা বন্ধ হলে তারা ভিন্ন নামে আরেকটা চালু করে। আগের লোকেরাই নতুন নামে চালু করে।
আমাদের দেশেও এখন এমনি একটি গ্রুপ অব কোম্পানিজ চালু আছে। দেশের আনাচে কানাচে বহু বছর মেয়াদী গাছ বিক্রয়ের ব্যবসাসহ বহুমুখী প্রোডাক্ট নিয়ে তারা এখন অনেক বড় একটি গ্রুপ। তাদের কারবারের বৈধতা নিয়ে জাতীয় সংসদেও বারবার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। আবার অজানা কারণে সেগুলো অগ্রসরও হয়নি।
আগেই বলে রাখি, কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপ বা ব্যক্তি চাই সে এমএলএম তরীকার হোক বা অন্য কোনো পন্থায় ব্যবসাকারী হোক তাদের সাথে আমাদের ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক বা খারাপ সম্পর্ক কিছুই নেই। এবং শুধু মুসলমানদের হালাল-হারামের বিষয় জিজ্ঞাসাসমূহের সার্বিক উত্তরের ব্যাপারে আমাদের দায়বদ্ধতা না থাকলে আমরা তাদেরকে নিয়ে ভাবতামও না।
এটি এজন্য যে, এ বিষয়ে শরঈ সমাধান পাওয়ার আগেই দ্বীনদার কিছু মুসলমান এতে জড়িয়ে পড়েছে। গুজবে কান দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের বাঙালিদের ক্ষতির (!) পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও শরঈ চিন্তা ছাড়াই একটা কিছুতে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা স্পষ্ট হল। ‘নেহি মালুম মানযিল হ্যায়, কিদহর কিস সামেত জাতে হ্যাঁ।/মাচা হ্যায় কাফেলে মে শোর, হাম ভি গুল মাচাতে হ্যাঁয়।’
অর্থনীতি বিষয়ে জড়িত হওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করা, চিন্তা-ভাবনা করা এটাকে আমরা অনেকে দরকারি মনে করি না। অথচ ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি এসব তো ইসলাম নামক বৃক্ষেরই বিভিন্ন শাখা। এগুলোকে দ্বীন/ইসলাম থেকে ভিন্ন ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এটা হল খৃস্টানদের বৈশিষ্ট্য। তারা মনে করে ধর্ম হল শুধু কিছু আচার-অনুষ্ঠানের নাম। আর অন্যান্য বিষয়গুলো একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। খৃস্টানদের এই প্রভাবটা ধীরে ধীরে মুসলমানদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। (আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাযত করুন।)
এখন আমরাও যদি কোনো মুয়ামালায় জড়িত হওয়ার পূর্বে চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করি তাহলে তো আমরাও তাদের মতো হয়ে গেলাম, যারা ইবাদত ও দ্বীনের অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ফরক করে। মোটকথা, এসব প্রেক্ষাপটেই মুফতী বোর্ড ঢাকার পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম এমএলএম ব্যবসার ব্যাপারে ফতোয়া দেওয়া হয়। তো এই ছিল আমাদের তখনকার তিক্ত অভিজ্ঞতা যে, দ্বীনদার শ্রেণীর লোকেরা যাচাই-বাছাই না করেই এতে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন যত দিন যাচ্ছে এ তিক্ত অভিজ্ঞতা ততই বাড়ছে। দ্বীনদার শ্রেণীর এই বিশাল গোষ্ঠিকে বাঁচানোর জন্যই আমরা ফতোয়া দিতে তৎপর হই।
এমএলএম পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত পরিচয়
এমএলএম এখন বেশ প্রসিদ্ধ একটি কারবার। অনেকেই এখন তা মোটামুটি চিনে। এরপরও প্রসঙ্গের টানে সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা দরকারী মনে হচ্ছে। এর আগে একটি ঘটনা শোনাই।
এমএলএম বিষয়ে প্রথম ফতোয়া আসার পর দূর থেকে অনেকেই বলত, যারা ফতোয়া দিয়েছেন তারা কি গুলশানে গিয়ে লেকচার শুনেছেন। তারা বিষয়টি না জেনেই ফতোয়া দিয়েছেন। আমরা সেসব রাস্তাঘাটের মানুষের কথার জবাব দেইনি। একদিন টংচেং এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ সম্ভবত ওদের ভাইস প্রেসিডেন্টসহ, আমাদের সাথে আলোচনায় বসলেন। তাদের মাঝে পাগড়িওয়ালা এক মুরববীও ছিলেন। আলোচনার মাঝে তিনি বলে উঠলেন, আপনারা যে ফতোয়া দিয়েছেন, আপনি কি গুলশানে গিয়ে লেকচার শুনেছেন? আমি বললাম, কোন লেকচারের কথা বলছেন? লোকটি বললেন, এমএলএম-এর মার্কেটিং পদ্ধতি বুঝতে হলে কোর্স করতে হয়, লেকচার শুনতে হয়। কর্মকর্তাদের কেউ এ কথা বললে অন্যভাবে জবাব দিতাম। তাকে বললাম, মুফতীকে ফতোয়া দিতে হলে ৫/-টাকার কোর্স করতে হবে-এটা আপনি ভাবলেন কি করে? মুফতী বোর্ডের ফতোয়ায় শরঈ হুকুম বলার আগে কারবারটির একটি বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মুফতী বোর্ড দিয়েছেন তাতে কী ভুল আছে বলুন। এমন কিছু কী বাদ থেকে গেছে যা থাকলে আজকের মাসআলার জবাব ভিন্ন হতে পারত? আমরা কি এমন কিছু লিখেছি, যা আপনারা বাস্তবে করেন না? বা আপনাদের স্বপক্ষে যেতে পারে এমন কোনো পয়েন্ট কি বাদ গেছে? তখন কর্মকর্তারা বললেন, না। আপনারা এই কারবারের যথাযথ বিশ্লেষণই করেছেন। কোনো কিছু ভুল বলেননি বা কিছু গোপনও করা হয়নি। তারা ঐ মুরববীকে চুপ থাকতে বললেন।
উক্ত ঘটনাটি এজন্য বললাম যে, অনেক হারাম কারবারীই আপনাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে পারে। প্রচলিত ভাষায় হাইকোর্ট ইত্যাদি দেখাতে পারে। কিন্তু ফতোয়ার কাজ যারা করবে তাদেরকে বিচলিত বা প্রভাবিত হলে চলবে না। যাহোক, এমএলএম-এর ব্যাখ্যা এই : Multi Level Marketing (M = Multi, L = Level, M = Marketing) Multi : বহু, নানা। যেমন : Multi Color (বহু বর্ণ), Multi National : (নানা দেশে সক্রিয়, বহুজাতিক), খবাবষ : স্তর, Marketing : ক্রয়বিক্রয়, বাজারে
পণ্য ছাড়া।
এককথায় এর অর্থ দাঁড়ায়,
বহুস্তরবিশিষ্ট বিপণন। এই অর্থ থেকেই অনেক কিছু বুঝে আসে। যেমন-
ক. বহু স্তরবিশিষ্ট বিপণন মানে প্রথম ক্রয়বিক্রয়ের পরই কারবার শেষ হয় না; বরং সামনে বহু স্তরে এটি চলমান থাকবে। (ব্যাখ্যা সামনে আসছে)।
খ. এখানে দুইটা জিনিস বা দুইটা পদবি একত্রে অর্জিত হয় ১. ক্রেতা ২. পরিবেশক। ওদের ফরমেই তা লেখা আছে। দুনিয়ার অন্যান্য কারবারে কেনা শেষ হওয়ার পর কেবল একটি পদবি অর্জিত হয়। তা হল ক্রেতা এবং জিনিসও একটিই অর্জিত হয় তা হল পণ্য বা নির্ধারিত সেবা। কিন্তু এখানে পদবী দুইটি, জিনিসও দুইটি। একটি হল পণ্য আর অপরটি হল ডিস্ট্রিবিউটরশীপ বা পরিবেশক হওয়ার যোগ্যতা। যেমন-ট্রি প্লান্টেশন। আপনি দশ হাজার টাকা দিয়ে ১২টি গাছ ক্রয় করলেন। এখানে আপনি একটি কিনলেন পণ্য। আরেকটি হল, উক্ত কোম্পানি থেকে কমিশন লাভের যোগ্যতা। আপনি আরো লোক যোগাড় করে দিতে পারলে কমিশন পাবেন। এতে বুঝা গেল, বিক্রয়টা এক স্তরে শেষ হয় না; বরং আপনার মাধ্যমে এবং আপনার পরবর্তী লোকদের মাধ্যমে তা বহু স্তরে বিস্তৃত হয়।
গ. আপনি কোম্পানিকে যে অর্থ দিয়ে তার সাথে জড়িত হলেন এর বিনিময়ে আপনি পাচ্ছেন দুইটি বিষয় : ১. পণ্য। তা হয়ত ক্ষেত্রবিশেষে নগদে পেয়ে যাবেন। ২. এটি থাকবে বাকি। যার নাম পরিবেশক হয়ে কমিশন প্রাপ্তি। আপনি নিজে অন্য ক্রেতা জোগাড় করে দিলে এবং সে ক্রেতারা আরো লোকজন নিয়ে আসলে আপনি পাবেন নির্ধারিত হারে কমিশন।
এটিকে নেটওয়ার্ক সিস্টেমও বলা হয়ে থাকে। তাই এমএলএম কোম্পানিগুলোর কারবারকে নেটওয়ার্ক বিজনেস বলেও আখ্যা দেওয়া হয়।
বিষয়টিকে সহজ করার জন্য একটি উদাহরণ টানা যেতে পারে। যেমন-ধরে নেওয়া যাক, গাছপালা লিমিটেড নামক একটি কোম্পানি ৫ বছর পর লাভসহ মূল দেওয়ার শর্তে ৫০০০/-টাকার বিনিময়ে ‘ক’ নামক ব্যক্তিকে ক্রেতা-পরিবেশক বানাল। এরপর ক নামক লোকটি উক্ত শর্তে খ ও গ নামক আরো দুজনকে কোম্পানির ক্রেতা-পরিবেশক বানাল। অতপর খ ও গ প্রত্যেকে কোম্পানিতে ভেড়াল যথাক্রমে ঘ, ঙ এবং চ, ছ কে। এভাবে প্রত্যেক নতুন ব্যক্তি দুজন করে ক্রেতা কোম্পানিতে নিয়ে আসবে। উপরোক্ত উদাহরণে ক নামক ব্যক্তি যেমনিভাবে খ ও গ নামক ব্যক্তিকে জোগাড় করার জন্য কোম্পানি থেকে কমিশন পাবে তেমনি স্থলবর্তী প্রত্যেক ব্যক্তি তথা ঘ, ঙ, চ, ছ সহ আরো যতজন এ লাইন দুটিতে নীচের দিকে যোগ হবে তাদের প্রত্যেকের অন্তর্ভুক্তির জন্য কোম্পানি তাকে বোনাস টাকা প্রদান করবে। এভাবে আপ লেভেল বা উপরের স্তরের ক্রেতাগণ ডাউন লেভেল তথা নিম্নস্তরের পরিবেশকদের মাধ্যমে টাকা উপার্জন করতে থাকবে এবং ঐ সব কোম্পানির ঘোষণা অনুযায়ী তারা বড় বড় পদবি অর্জন করে দেশ-বিদেশে ভ্রমণসহ বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে থাকবে।
আপনারা হয়ত অবগত আছেন যে, এ জাতীয় লোভনীয় অফারগুলোই এদেশের অনেক স্বল্প আয়ী বা বেকার লোকজনকে এমএলএম কোম্পানিগুলোর অফিসমুখী করে থাকে।
এতক্ষণ আলোচনা থেকে আমরা বুঝলাম যে, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানিগুলোতে শুরু শুরুতে যে লোকেরা জড়িত হয় তারাই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। পক্ষান্তরে ডাউন লেভেল বা পরের দিকে আসা সদস্যগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে এবং একটি পর্যায়ে গিয়ে ঐ কোম্পানি বা তার নির্দিষ্ট প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। ভারতের গবেষকগণ হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, তাদের মতো পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশেও যদি ১জন ক্রেতা-পরিবেশক গড়ে ১০জন করে লোক কোম্পানিতে যোগ করায় এবং যদি পুরো দেশের ১০০ কোটি মানুষ এর সাথে যুক্ত হয় (যা অসম্ভব) তবুও কারবারটি দশম স্তরে গিয়ে বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। বিষয়টি এভাবে বুঝা যেতে পারে। প্রথমজন ১০ জনকে, তারা প্রত্যেকে ১০ জন করে ১০০ জন, এরা সকলেই ১০ জন করে ১০০০। এভাবে দশম স্তরে গিয়ে হয়ে যাবে ১০০ কোটি। আর যদি প্রত্যেকের ২ জন করে হিসাব করা হয় তবে ২৭ তম স্তরে গিয়ে ১৩ কোটির ১টি দেশের সকল জনসংখ্যাও যদি তার পরিবেশক হয়ে যায় তবুও কারবারটি বন্ধ হয়ে যাবে।
এতক্ষণের বক্তব্য থেকে আমরা বুঝলাম যে, সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে এমএলএম ব্যবসার ধরন ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ :
* সাধারণ ব্যবসায় বিক্রেতার কাজ থাকে পণ্য বিক্রয় করা। আর এমএলএম কোম্পানি সদস্য বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকে।
* সাধারণ ব্যবসায় ক্রেতার মূল উদ্দেশ্য থাকে পণ্য। তাই পণ্যের গুণগত মান ও মূল্যের বিষয়টি তার কাছে মুখ্য থাকে। অন্যদিকে এমএলএম এর ক্রেতাগণের কাছে মুখ্য বিষয় হচ্ছে ডিস্ট্রিবিউশনশীপ বা পরিবেশক হওয়া। পরিবেশক হয়ে কমিশন ও বোনাস অর্জন করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকে। পণ্য তারা কেনে একপ্রকার বাধ্য হয়েই। তাই এর গুণগত মান ও মূল্যটি মুখ্য কোনো বিষয় নয় তাদের কাছে। এজন্যই যে গাছ কোম্পানির বক্তব্য অনুযায়ী এখনো চারা, যা তারা কখনো দেখেইনি এবং ভবিষ্যতেও কোম্পানি দেখাতে অনাগ্রহী সে গাছগুলোই তারা খরিদ করছে চড়া মূল্যে।
* খুব স্বাভাবিক কারণেই চাহিদা ও যোগানের সামঞ্জস্য নষ্ট হওয়ায় এ কারবারের নীচের দিকের (ডাউন লেভেল) লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। সাধারণ বেচা-কেনায় এমনটির চিন্তাও করা হয় না।
এ পর্যন্ত এমএলএম কারবারের সংক্ষিপ্ত একটি চিত্র তুলে ধরা হল। এখন আমরা এর শরঈ বিশ্লেষণ ও হুকুম নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ এবং এর পরেই থাকবে প্রশ্নোত্তর পর্ব।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)...
প্রিয়আলোতে পড়ুনঃ
ই-কমার্স নাকি এমএলএম কমার্স?
এম.কে. ত্বহা, পর্ব- ০১ঃ ই-কমার্সের মোড়কে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) বা বহুমুখী পণ্য বিপণন পদ্ধতির নামে সারা দেশে চলছে লোক ঠকানোর ব্যবসা। অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে এসব ভুঁইফোঁড় কোম্পানির মালিক পক্ষ। প্রতারণার অভিযোগে সরকার এ পর্যন্ত ৪৫টি কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল করেছে। এছাড়াও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ছয়টি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করলেও বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো লোক ঠকানোর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা শূন্য হাতে ব্যবসা শুরু করে এবং প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়। প্রতারকরা অতি অল্প সময়ে দেশ-বিদেশে বাড়ি-গাড়ি কিনে বিত্তবান হলেও প্রতারণার শিকার অসংখ্য মানুষ আজ দিশেহারা, লাঞ্ছিত হচ্ছে পারিবারিক এবং সামাজিক স্তরের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
দিনের পরে যেমন নতুন দিন আসে, ঠিক তেমনি একটির পর একটি প্রতারনার কোম্পানিও আসে। আসে মানুষকে রাতারাতি স্বপ্নের বাড়ী, ফ্ল্যাট, জমি এবং গাড়ির মালিক বানাতে। কিছুদিন পর এমএলএম নামক হায় হায় কোম্পানিটির যখন যায় যায় অবস্থা , ততোক্ষণে অনেকের পৈত্রিক বাড়ীটিও উধাও হয়ে মিলিয়ে যায় দূর নীলিমায়।
ই-কমার্সের খোলসে এমনই এক নতুন এমএলএম কোম্পানি ” প্রিয়জন ই-কমার্স লিমিটেড “। যাদের নেই কোন এমএলএম এর লাইসেন্স। এমনকি লাইসেন্সের জন্য আবেদন পর্যন্ত করেনি কেউ! কী অবাক হচ্ছেন? সামনে আরও কিছু অপেক্ষা করছে…
আইনজীবী, বিতর্কিত ডেসটিনি-২০০০ লি. এর কিছু বিপণন কর্মী, ই-লিঙ্কস নামক গ্যাম্বলিং কোম্পানির জুয়াড়িদের সমন্ব্য়ে গঠিত মালিক পক্ষ এবং এমএলএম লাইসেন্স নবায়ন না পাওয়া ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ লি. নামক এমএলএম কোম্পানি থেকে চলে আসা কিছু এমএলএম কর্মীদের নিয়ম বহির্ভূত বিপণন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে ” প্রিয়জন ই-কমার্স লিমিটেড ” নামক এই কোম্পানিটির কার্যক্রম।
শুধুই কি তাই? ধার করা মানহীন পণ্য, হাইব্রিড পণ্য, বিশেষ রোগের ম্যাজিক সমাধান! শারিরিক শক্তিমত্তা বৃদ্ধির ভয়ংকর সব কেমিক্যালযুক্ত পণ্যের সম্ভার দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছে এই ব্যবসা, রাজধানী ঢাকাতেই। বিশ্বাস করতে না চাইলেও সত্য যে, “বি সি এস আই আর” থেকেও নেয়া হয়নি পণ্যের শুদ্ধতার কোন একটিরও সার্টিফিকেট। এ ব্যাপারে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শরীফ রায়হানের শরণাপন্ন হলে তিনি জানান; “মানহীন পণ্যের ভয়াবহতার কবলে মৃত্যু ঝুঁকির এক ভয়ংকর তথ্য”।
.
কথায় বলে; ” চোরেরও ধর্ম আছে “! কিন্তু এই কোম্পানির ব্যবসার কোন একটিও ধর্ম আপনি খুঁজে পাবেন না। একে তো, দুই টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে হাজার টাকা অনুপাতে, তার উপর মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে তাঁদের কমিশন থেকেও! কী বুঝলেন? আরও পরিস্কার করছি-
.
” প্রিয়জন ই-কমার্স লিমিটেড ” এর একাধিক ডিস্ট্রিবিউটর (নাম না প্রকাশের শর্তানুযায়ী) মালিক পক্ষের লোকদের বিরুদ্ধে প্রকাশ করছেন চরম অসন্তোষ এবং বিক্ষুদ্ধ মনোভাব। তাঁর মাধ্যমেই জানা যায়- ঢাকা, সিলেট, জামালপুর, চাঁদপুর, ময়মনসিং, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন থানা ও জেলা পর্যায় থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বিপুল অংকের নগদ অর্থ। মাঠ পর্যায়ে শেষ সারির ভুক্তভোগীদের ( মন্দের ভালো ) কমিশন নিয়েও চলছে ছলচাতুরী এবং নানা রকম টালবাহানা। পণ্য পাও আর না পাও, টাকা দাও-কমিশন নাও নামক মিথ্যা আশ্বাসকে মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে বিশ্বাস করিয়ে, প্রয়োজনে কূট-কৌশলে বাধ্য করেও টাকা আত্মসাৎ করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে।
.
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আল আমিন এর সাথে এ সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি ব্যস্ততার কারন দেখিয়ে এড়িয়ে যান।
.
প্রশাসন এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন এবং যে কোন সময়েই পদক্ষেপ গ্রহন করবেন বলে আশাবাদী প্রতারিত সাধারন ব্যক্তিগণ। এবং কোম্পানির মালিক পক্ষ অর্থ আত্মসাৎ করে কোন ভাবেই যেন বিদেশ পালিয়ে যেতে না পারে, সে ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট মহলকে জানিয়েছেন কোম্পানির প্রতারণার শিকার এমন কয়েকজন।
” প্রিয়জন ই-কমার্স লিমিটেড ” এর ওয়েবসাইট দেখলে মনে হবে এটি নিছক একটি ই- কমার্স সাইট! আসল ব্যাপারটি হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতেই এই কৌশল তাঁদের। লগ ইন করলেই বের হয়ে আসে সেই চিরায়িত রুপ- ডান হাত আর বাম হাত!! তাছাড়া কোম্পানির ওয়েব সাইটের স্ক্রীন শটের দিকে খেয়াল করলেই স্পষ্ট হয় যে, ই-কমার্স সাইটের ক্রেতাদের কখনো এমন পদবী হয় না। লাল বৃত্তের দিকে তাকালে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
উল্লেখ্য,
দেশে এমএলএম (বহুস্তর বিপণন পদ্ধতি) কোম্পানির প্রতারণা বন্ধ হয়নি। এসব প্রতিষ্ঠানের এমএলএম ব্যবসা করার কোনো সনদ না থাকলেও প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালাচ্ছে। অধিক লাভের প্রলোভন দেখিয়ে সদস্য বানাচ্ছে সহজ-সরল তরুণ-তরুণীদের। প্রসাধনী ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ উচ্চ দামে সদস্যদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন কোম্পানির কর্মকর্তারা। আর ভবিষ্যৎ আয়ের আশায় তাদের সেই পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছেন বেকার যুবক-যুবতীরা। আইনে বলা হয়, পিরামিডসদৃশ বিপণন কার্যক্রম চালানো, সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ মোড়কজাত না করে পণ্য বিক্রি, প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী পণ্য বা সেবা বিক্রি না করা, পণ্য বা সেবার অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ, নিন্ম মানের পণ্য বা সেবা বিক্রি করা এবং অসত্য, কাল্পনিক ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এমতাবস্থায়, সরকারি বিধি-নিষেধ থাকা স্বত্ত্বেও যদি আইনের সুস্পষ্ট লংঘন করে প্রতারণা করা কিছু মানুষের স্বভাব হয়ে যায়, তবে সাধারন মানুষদের পথে বসা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। সুতরাং সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঠিক পদক্ষেপের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে প্রতারিত ব্যক্তিদের।
[বি.দ্রঃ পোস্টটি পড়তে, উপরের রঙিন লেখাটিতে ক্লিক করুন]
এবার আসুন ”কুরআনের আল“ কি বলে এমএলএম সম্পর্কে কি বলে শুনে নিইঃ
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
রহমান রহীম আল্লাহ্ তায়ালার নামে-
সংকলন : মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম | গ্রন্থনা ও পরিমার্জনা : ডাঃ মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) বা বহুজাত বিশিষ্ট পণ্য বাজারজাত পদ্ধতি বাংলাদেশে নতুন হলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে অর্ধ শতকের বেশি সময় আগে এটি চালু হয়েছিল। নেটওয়ার্ক মার্কেটিং, ডিরেক্ট সেলিং ও রেফারেন্স মার্কেটিং হিসাবেও এটি পরিচিত। মাল্টিলেভেল মার্কেটিং মূলত ডিস্ট্রিবিউটরদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা বিক্রি করার একটি প্রক্রিয়া। আধুনিক অভিধানে এর সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয় : (Multi-level marketing, also known as MLM or network marketing, is a business structure where products are sold through a networking process as opposed to a storefront. … is a way of selling goods and services through distributors) অর্থাৎ ‘মাল্টি লেভেল মর্কেটিং যা এএলএম বা নেটওয়ার্ক মার্কেটিং নামেও পরিচিত, তা হল একটা ব্যবসায় পদ্ধতি যেখানে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করা হয় … আর তা মূলত ডিস্ট্রিবিউটরদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা বিক্রি করার একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় আপলাইন ও ডাউনলাইন নামে বহু স্তরের (Multi level) ডিস্ট্রিবিউটর তৈরি হয়। ডাউনলাইনের কোনো ব্যক্তি কর্তৃক বিক্রিত পণ্যদ্রব্যের একটি কমিশন আপলাইনের ডিস্ট্রিবিউটররা পেয়ে থাকে। একে সংক্ষেপে MLM বলা হয়। যেসব দেশে এ ব্যবসা প্রচলিত রয়েছে সেখানে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো আইন না থাকায় তা এখনও চালু রয়েছে। ব্যক্তিস্বাধীনতার সর্বোচ্চ বিকাশের কারণে অনেকাংশেই ব্যবসাটি বহাল রয়েছে। কিন্তু সেসব দেশের সচেতন মহল প্রতিনিয়তই জনগণকে এ ব্যবসায় সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত করছে।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের জনবহুল দেশগুলোর অন্যতম। এ দেশে যেমনি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি তেমনি বেকার লোকের সংখ্যাও কম নয়। শতকরা ৬৫ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে দরিদ্র ও বেকারদের অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে এমএলএম ব্যবসায়। কিন্তু যেহেতু এদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী সেহেতু মু’মিনদের অন্তরে একটি সংশয় রয়েই যাচ্ছে যে এ ব্যবসাটি শরী‘আতের সাথে সংগতিপূর্ণ কিনা? আমরা আমাদের এ প্রবন্ধে সে দিকটিই তুলে ধরার প্রয়াস চালাবো ইনশাআল্লাহ।
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর শরয়ী বিধান :
মাল্টিলেভেল মার্কেটিং-এর শরয়ী বিধান আলোচনা করার পূর্বে ইসলামি শরী‘আতের কতিপয় বিধান ও নীতিমালা যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে ব্যবসা ও লেনদেনের বৈধতা-অবৈধতা নির্ভর করে সেগুলো আলোচনা করা দরকার। নিম্নে সংক্ষেপে তা আলোকপাত করা হলো:
(ক) ইসলামি শরী‘আতে হালাল ও হারাম উভয়টিই সুস্পষ্ট। শরী‘আত যেটা হালাল করেছে সেটাকে হারাম করা বা ঘোষণা দেয়া আবার যেটা হারাম করেছে সেটাকে হালাল ঘোষণা দেয়ার অধিকার আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কারও জন্য প্রযোজ্য নয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে সীমালঙ্ঘনকারীদের সাবধান করে ঘোষণা দিয়েছেন,
﴿قُلۡ أَرَءَيۡتُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ لَكُم مِّن رِّزۡقٖ فَجَعَلۡتُم مِّنۡهُ حَرَامٗا وَحَلَٰلٗا قُلۡ ءَآللَّهُ أَذِنَ لَكُمۡۖ أَمۡ عَلَى ٱللَّهِ تَفۡتَرُونَ ٥٩﴾ [يونس: 59]‘‘তুমি বল, তোমরা কি কখনো এ কথা চিন্তা করে দেখেছ, আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের জন্য যে রিযক নাযিল করেছেন তার মধ্য থেকে কিছু অংশকে তোমরা হারাম আর কিছু অংশকে হালাল করে নিয়েছ; তুমি বল, এসব হালাল-হারামের ব্যাপারে আল্লাহ তোমাদের কোনো অনুমতি দিয়েছেন, না তোমরা আল্লাহ্র প্রতি মিথ্যা আরোপ করছ? [সূরা ইউনুস, আয়াত : ৫৯]
(খ) ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি মূলনীতি হলো তা বৈধ ও অনুমোদিত।[1] সুতরাং যে ব্যবসার ক্ষেত্রে শরী‘আতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেগুলো ছাড়া অন্য সকল ব্যবসা বৈধ। কোনো ব্যবসাকে হারাম সাব্যস্ত করতে হলে এর পক্ষে শরয়ী নিষেধাজ্ঞা থাকতে হবে। কোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে শরয়ী নিষেধাজ্ঞা না থাকলে ধরে নিতে হবে তা হালাল ও অনুমোদিত।
(গ) ইসলামি শরী‘আত যা যা হালাল করেছে এবং যা যা হারাম করেছে তা সম্পূর্ণ ইনসাফের ভিত্তিতে করেছে। যার মধ্যে মানুষের কল্যাণ রয়েছে শরী‘আত প্রণেতা শুধু তাই তাদের জন্য হালাল করেছেন এবং যার মধ্যে তাদের অকল্যাণ রয়েছে তাই তাদের জন্য হারাম করেছেন। আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে হালালের কল্যাণ এবং হারামের অকল্যাণ বুঝে আসুক বা না আসুক তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের দাবি। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন,
﴿وَيُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيۡهِمُ ٱلۡخَبَٰٓئِثَ وَيَضَعُ عَنۡهُمۡ إِصۡرَهُمۡ وَٱلۡأَغۡلَٰلَ ٱلَّتِي كَانَتۡ عَلَيۡهِمۡۚ﴾ [الأعراف: 157]‘‘যে তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে এবং অপবিত্র বস্তু হারাম করে; আর যে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার ও শৃংখল হতে, যা তাদের ওপর ছিল।’’ [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত : ১৫৭]।
(ঘ) ক্রেতা-বিক্রেতার সম্মতি ও আন্তরিক সন্তুষ্টি থাকা। বেচা-কেনা বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য একটি শর্ত হলো ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতি ও সন্তুষ্টি। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এ মর্মে ঘোষণা করেছেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ إِلَّآ أَن تَكُونَ تِجَٰرَةً عَن تَرَاضٖ مِّنكُمۡۚ﴾ [النساء: 29]‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না; কিন্তু তোমাদের পরস্পর রাযী হয়ে ব্যবসা করা বৈধ’’ [সূরা আন-নিসা : ২৯]।
তবে সম্মতি ও সন্তুষ্টি বলতে সব ধরনের সম্মতি ও সন্তুষ্টিই এখানে উদ্দেশ্য নয়। বরং হাদীস থেকে জানা যায় এখানে সম্মতি ও সন্তুষ্টি দ্বারা উদ্দেশ্য হলো বেচা-কেনার ক্ষেত্রে শরী‘আত যে সকল নীতিমালা নির্ধারণ করেছে সেগুলোর আওতায় থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতি ও আন্তরিক সন্তুষ্টি থাকা। কাজেই শরী‘আত অসংগত কোনো বিষয়ে কারও পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি ও সম্মতি থাকলেও সেটা ইসলামি শরী‘আতের বিচারে হালাল ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত হবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, মদ ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর যদি ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে সম্মতি ও আন্তরিক সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তথাপি তা বৈধ হবে না। কারণ মদটাকে ইসলাম হারাম করেছে। অনুরূপ সুদের কারবার যদি কেউ সন্তুষ্টচিত্তে করে তথাপি তা বৈধ হবে না। কারণ ইসলাম সুদকে হারাম করেছে। আবার ব্যবসার ক্ষেত্রে যদি প্রতারণা ও ধোঁকার আশ্রয় নেয়া হয় তবে সেখানেও ক্রেতা-বিক্রেতার সম্মতি ও আন্তরিক সন্তুষ্টি সেটাকে বৈধ করতে পারে না। কারণ ইসলাম প্রতারণাকে হারাম করেছে।
আমরা আমাদের এ প্রবন্ধে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর বৈধতা-অবৈধতার বিষয়টি দু’টি দিক থেকে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্।
প্রথমত : ভিত্তিগত (substantive and theoretical)
দ্বিতীয়ত : পদ্ধতিগত (procedural)
ভিত্তিগত দিক : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর পদ্ধতি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের হলেও তত্ত্বগত ভিত্তিটি(theoretical basis) সবসময় একই। তা হলো, নিম্ন লেভেলের ডিস্ট্রিবিউটর কর্তৃক বিক্রিত পণ্যের একটি কমিশন সর্বোচ্চ লেভেল পর্যন্ত পায়। যেটাকে এক কথায় ‘শ্রমের বহুস্তর সুবিধা’ বলা যায়। কোনো কোনো লেখক এর নাম দিয়েছেন ‘‘Chain reaction of labour’’, কেউবা আবার ব্যক্ত করেছেন ‘‘Chain pyramidal commission’’ কিংবা ‘‘Compound brokerage’’ ইত্যাদি নামে। তাদের এ নীতিটির সাথে ইসলামের শ্রমনীতির রয়েছে সরাসরি সংঘর্ষ। কারণ ইসলামের শ্রমনীতি হলো,
﴿أَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٞ وِزۡرَ أُخۡرَىٰ ٣٨ وَأَن لَّيۡسَ لِلۡإِنسَٰنِ إِلَّا مَا سَعَىٰ ٣٩﴾[النجم: 38-39]‘‘কোনো মানুষই অপরের বোঝা উঠাবে না। মানুষ ততটুকুই পাবে যতটুকু সে চেষ্টা করে’’ [সূরা আন-নাজম, আয়াত : ৩৮-৩৯]।
এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে, মানুষ কেবল তার নিজের শ্রমের প্রত্যক্ষ ফল লাভের অধিকারী। কারও নিযুক্ত কর্মী না হলে একজন আরেকজনের শ্রমের ফলে অংশীদার হতে পারে না। একইভাবে মানুষ তার শ্রমের ফল কেবল নিকটবর্তী লেভেল থেকে আশা করতে পারে। কোনো ক্রমেই তা বহুস্তর (multi level) পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে না। এটি যেমন ইসলামি শ্রমনীতির সাথে অসংগতিপূর্ণ তেমনি মানবীয় বুদ্ধি বিবেচনায় অস্বীকৃত। কারণ, এ ব্যবসায় এক পর্যায়ে দেখা যায় নিম্নলেভেলের ডিস্ট্রিবিউটর ফরিদপুরের মাসুদ উচ্চলেভেলের ডিস্ট্রিবিউটর বরিশালের নোমানকে চিনে না, তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ ও কথা-বার্তা নেই অথচ নিম্নলেভেলের মাসুদ থেকে উচ্চলেভেলের নোমান কমিশন পাচ্ছে। মানবীয় সুস্থ বিবেক বলছে, কোনো পণ্যের পেছনে যে প্রত্যক্ষ শ্রম দিয়েছে কেবলমাত্র সেই পারিশ্রমিক পেতে বাধ্য। কিন্তু যে পরোক্ষ শ্রম দিয়েছে সে পারিশ্রমিক পেতে বাধ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন শিক্ষক সে তার প্রত্যক্ষ শ্রমের ফল হিসেবে বেতন দাবি করতে পারে। কিন্তু সে যদি দাবি করে, তার ছাত্ররা যত জনকে শিক্ষিত করে কর্মক্ষম করে তুলবে এবং ভবিষ্যতে তারা আরও যাদেরকে শিক্ষিত করে তুলবে তাদের প্রত্যেকের আয়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ উর্ধবতন শিক্ষককে কমিশন হিসেবে দিতে হবে তাহলে বিষয়টি মেনে নেয়ার মত নয়। কারণ এখানে শিক্ষকের শ্রম শুধু তার সরাসরি ছাত্রদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তার ছাত্রদের ছাত্র বা তাদের ছাত্রের প্রতি তাঁর কোনো শ্রম নেই। তার শ্রমের ভিত্তিতে সরাসরি তার ছাত্রদের কাছ থেকে সে বেতন বা সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে কিন্তু ডাউনলাইনের ছাত্রদের কাছ থেকে সে কিসের ভিত্তিতে কমিশন বা বেতন ভোগ করবে?
সুতরাং ইসলামি শ্রমনীতি ও মানবীয় বুদ্ধি বিবেচনায় শ্রমের বহুস্তর সুবিধা (multi level benefit of labour)নীতিটি শরী‘আত সম্মত হতে পারে না। অথচ এ নীতিটিই মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর সবচেয়ে বড় তাত্ত্বিক ভিত্তি। এ ভিত্তি সরিয়ে ফেললে এ প্রকার ব্যবসার অস্তিত্বই থাকবে না। কোনো সাধারণ কোম্পানি থেকে পণ্য কিনে অপরজনের কাছে বিক্রির মাধ্যমে লাভবান হওয়ার বৈধ অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। অনুরূপ কোনো ক্রেতা সংগ্রহ করে দেয়ার মাধ্যমে কোম্পানির কাছ থেকে দালালীর কমিশন (brokerage fee) নেয়ার অধিকারও প্রত্যেকের রয়েছে। কারণ এ উভয় ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ শ্রম জড়িয়ে আছে। এ প্রত্যক্ষ শ্রমের প্রত্যক্ষ সুবিধা নিকটতম স্তর থেকে একবারই পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ একটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট ভ্যালুর পণ্য কিনে দালালীর অধিকার অর্জন করা যা বাস্তবায়ন করতে প্রত্যক্ষ শ্রম দিয়ে নতুন ক্রেতা সংগ্রহ করতে হয়। যে যত বেশি ক্রেতা সংগ্রহ করতে পারে সে ততজনের কমিশন লাভ করার অধিকার রাখে। কিন্তু কোনো ক্রমেই আপলেভেলের প্রত্যক্ষ শ্রম স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সুদূর-বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে না। অথচ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ তা-ই ঘটে।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে, প্রত্যেক ব্যক্তির আয় ও দায় (income and liability) সবসময় ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। তবে এ স্বাভাবিক নীতির ব্যতিক্রম যে সকল বৈধতা শরী‘আতে পাওয়া যায় তা শরী‘আতের বিধান হিসেবে সমালোচনার উর্ধ্বে। যেমন ধনীর সম্পদে অভাবী মানুষের অধিকার, সদকায়ে জারিয়ার সাওয়াব, গোনাহে জারিয়া ইত্যাদি। এগুলো শরী‘আত প্রণেতা কর্তৃক গৃহীত। কাজেই তা স্বাভাবিক নিয়ম বহির্ভূত।
পদ্ধতিগত দিক : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর তাত্ত্বিক ভিত্তি (Theoretical Basis)-এর সাথে ইসলামের প্রতিষ্ঠিত শ্রমনীতি ও মানবীয় বুদ্ধি বিবেচনার সাংঘর্ষিক দিকটি আলোচনা করার পর এবার আমরা এর কিছু পদ্ধতিগত সংঘাত নিয়ে আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ্।
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা নেটওয়ার্ক-এর পদ্ধতিসমূহের মধ্যে শরী‘আত নিষিদ্ধ বহু বিষয় বিদ্যমান। যার প্রধানগুলো নিম্নরূপ :
- শ্রমবিহীন বিনিময় এবং বিনিময়বিহীন শ্রম (الأجرة بلا عمل والعمل بلا أجرة)
- একটি আকদ (চুক্তি)-এর জন্য আরেকটিকে শর্ত করা (جمع الصفقتين في صفقة)
- অর্জিত হওয়া না-হওয়ার অনিশ্চয়তা (الغرر)
- সুদের সাদৃশ্য ও দৃঢ় সন্দেহ (شبهة الربا)
- জুয়ার সাদৃশ্য (شبهة الميسر)
- বাতিল পন্থায় মানুষের মাল ভক্ষণ (أكل أموال الناس بالباطل)
- প্রতারণা ও ধোঁকা (الغش)
- বর্ধিত মূল্যে বিক্রয় (البيع بالسعر الغالي)
- ‘আকদুল ইজারাহ’-এর উসূল পরিপন্থী (خلاف أصول عقد الإجارة)
নিম্নে প্রতিটির বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো :
(ক) শ্রমবিহীন বিনিময় এবং বিনিময়বিহীন শ্রম (الأجرة بلا عمل والعمل بلا أجرة) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং পদ্ধতি শরী‘আতের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো এতে ‘শ্রমবিহীন বিনিময় এবং বিনিময়বিহীন শ্রম’ রয়েছে যা ইসলামি আইন সমর্থন করে না।
বিনিময়বিহীন শ্রমের বিষয়টি ফুটে উঠে তাদের প্রচলিত সে নীতিতে যাতে রয়েছে, একজন ডিস্ট্রিবিউটর (পরিবেশক)-এর ডান ও বাম উভয় দিকের নেট না চললে সে কমিশন পাবে না। অর্থাৎ কেউ যদি নির্ধারিত পয়েন্টের একজন ক্রেতা জোগাড় করে কিন্তু আরেকজন জোগাড় করতে অক্ষম হয়, তবে লোকটি কমিশন থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হবে। এমনিভাবে কেউ যদি দু’জন ক্রেতাও কোম্পানিকে এনে দেয়, কিন্তু তারা কোম্পানির নির্ধারিত পয়েন্ট থেকে কম পয়েন্টের মালামাল ক্রয় করে তবে এর জন্যও ঐ ব্যক্তি কমিশন পায় না। ফলে এটি বিনিময়বিহীন শ্রমে পরিণত হয় যা ইসলামি আইনে নিষিদ্ধ। হাদীসে কুদসীতে রয়েছে, আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
« ثَلاثَةٌ أَنَا خَصْمُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ أَعْطَى بِي ثُمَّ غَدَرَ وَرَجُلٌ بَاعَ حُرًّا فَأَكَلَ ثَمَنَهُ وَرَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أَجِيرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِ أَجْرَهُ »‘‘কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির সাথে ঝগড়া করবো। (এক) যে ব্যক্তি আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে। (দুই) যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রয় করে তার মূল্য ভোগ করে এবং (তিন) যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে নিযুক্ত করে তার কাছ থেকে কাজ আদায় করার পর মজুরী পরিশোধ করে না’’ [সহীহ বুখারী : ২২২৭]।
ইসলামি শরী‘আতে ‘একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কাজ করতে না পারলে পারিশ্রমিক পাবে না’ এ ধরনের শর্ত দিয়ে কোনো চুক্তি করা বৈধ নয়। আল্লামা ইবন রুশদ তার ‘আল-মুকাদ্দামাত’ গ্রন্থে বলেছেন,
‘‘কাপড়ের নির্দিষ্ট সংখ্যার ওপর এ চুক্তি করে লোক নিয়োগ দেয়া যে, ‘কাপড়ের এত সংখ্যক বিক্রয় করতে না পারলে সে কোনো পারিশ্রমিক পাবে না’ তাহলে চুক্তিটি বৈধ হবে না। কারণ এরূপ ক্ষেত্রে নিয়োগদাতা কর্মচারীর অল্প সংখ্যক বিক্রয় দ্বারা যে উপকৃত হচ্ছে তা তার জন্য বৈধ হবে না।’’[২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০৯]
আর শ্রমবিহীন বিনিময়টি সুন্দরভাবে ফুটে উঠে তাদের ভিত্তিগত দিকে যা ইতোপূর্বে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, তাদের নীতিমালা রয়েছে, কোনো ব্যক্তি নির্ধারিত পরিমাণ পণ্য খরিদান্তে ডিস্ট্রিবিউটর (পরিবেশেক) হওয়ার পর যদি সে দু’জন ক্রেতা নিয়ে আসে এবং তারা প্রত্যেকে আরও দু’জনকে এবং সে চার জন আরও আটজনকে কোম্পানির সাথে যুক্ত করে, তবে প্রথম ব্যক্তি এবং দ্বিতীয় লেভেলের দু’ব্যক্তি নিম্ন লেভেলের আট ব্যক্তি ক্রেতা-পরিবেশকের সুবাদেও কোম্পানি থেকে কমিশন পেয়ে থাকে। অথচ এ আটজনের কাউকেই প্রথম ব্যক্তি ও দ্বিতীয় লেভেলের দু’ব্যক্তি কোম্পনির সাথে যুক্ত করে নি; বরং সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর নীতি অনুযায়ী এরা কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়েছে তাদের সরাসরি ওপরের ব্যক্তির রেফারেন্সে এবং এর জন্য ঐ ব্যক্তি নির্ধারিত হারে কমিশনও পাবে। এটি সুস্পষ্টই শ্রমবিহীন বিনিময় যা ইসলামে নিষিদ্ধ।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে, তাদের এ কারবারে বিনিময়বিহীন শ্রম ও শ্রমবিহীন বিনিময় দু’টিই পুরোপুরিভাবে বিদ্যমান রয়েছে যা শরী‘আতের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।
(খ) একটি আকদ (চুক্তি)-এর জন্য আরেকটিকে শর্ত করা (جمع الصفقتين في صفقة) : মাল্টি লেভেল নেটওয়াকিং বৈধ না হওয়ার আরও একটি অন্যতম কারণ হলো এতে হাদীসে নিষিদ্ধ ‘একই চুক্তির জন্য আরেকটিকে শর্ত করা’-এর বিষয়টি রয়েছে। কারণ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ পণ্য ক্রয়ের শর্তেই শুধু ডিস্ট্রিবিউটর হওয়া যায়। অর্থাৎ কোম্পানি থেকে পণ্য ক্রয় ছাড়া ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে এখানে পণ্য ক্রয়কে ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার জন্য শর্ত করা হচ্ছে, যা হাদীসে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
« لاَ تَحِلُّ صَفْقَتَانِ فِيْ صَفْقَةٍ »‘‘একই আকদের জন্য আরেকটিকে শর্ত করা হালাল নয়’’ [তবারানী : ১৬১০]।
অপর এক হাদীসে রয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেন,
نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ صَفْقَتَيْنِ فِي صَفْقَةٍ وَاحِدَةٍ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই আকদে (চুক্তিতে) দু’টি আকদ (চুক্তি) করতে নিষেধ করেছেন’’ [মুসনাদ আহমাদ : ৩৭৮৩]।
এ প্রকারের বেচা-কেনা সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেন,
صَفْقَتَانِ فِيْ صَفْقَةٍ رِبًا‘‘একটি আকদ (চুক্তি)-এর জন্য আরেকটিকে শর্ত করা সুদী কারবার।’’ [সহীহ ইবন হিব্বান : ১০৫৩]
ইমাম শাফিঈ রহ. এ ধরনের হাদীসের দু’টি ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন,
এক. বিক্রেতা বলল, আমি এ পণ্যটি তোমার নিকট নগদে বিক্রি করলে এত টাকায় বিক্রি করব আর বাকিতে বিক্রি করলে এত টাকায় বিক্রি করবো। অর্থাৎ নগদে কিনলে মূল্য কম ধরা হবে।
দুই. বিক্রেতা বলল, আমি তোমার নিকট এটি ধরা যাক একশত টাকায় বিক্রি করছি, তবে শর্ত হলো আমার নিকট তোমার ঘরটি এত টাকার বিনিময়ে বিক্রি করতে হবে।
ইসলামিক স্কলারদের সর্বসম্মতিক্রমে এ দু’প্রকারের লেনদেনই বাতিল ও অবৈধ। মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর পদ্ধতি ইমাম শাফিঈর ব্যাখ্যার দ্বিতীয়টির সাথে মিলে যায়। কারণ তারা ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার জন্য পণ্য ক্রয়কে শর্ত করে থাকে। যা আকদের ওপর আকদের নামান্তর।
কোনো কোনো মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি উপরোক্ত শরয়ী সমস্যা এড়ানোর জন্য দু’টি পৃথক ফরমের ব্যবস্থা করেছে। একটি পণ্য ক্রয়ের অর্ডার ফরম, অন্যটি ডিস্ট্রিবিউটরশীপের আবেদন ফরম। তারা বুঝাতে চেয়েছে, এখানে পৃথক দু’টি চুক্তি হচ্ছে। অথচ মূলত কার্যক্ষেত্রে একটি চুক্তির জন্য অন্যটি এখনও জরুরি। অর্থাৎ পণ্য-ক্রয় ছাড়া ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া দুই ফরমবিশিষ্ট এ ধরনের কোম্পানির নীতিমালায় সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, ‘‘আপনি কি জানেন যে, নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য ক্রয় ছাড়া এখানে ডিস্ট্রিবিউটর হবার কোন সুযোগ নেই?’’ [ডেসটিনি-২০০০ লিমিডেট, বিক্রয় ও বিপনন পদ্ধতি, পৃষ্ঠা : ২৬]এমনকি এ সকল কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরশিপ ফরমেও বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে এসেছে। আবার ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার জন্য পণ্য ক্রয়ের শর্তের কথাতো দুই ফরমধারীগণও অস্বীকার করেন না; বরং তারা তো ডিস্ট্রিবিউটরদেরকে ‘ক্রেতা ডিস্ট্রিবিউটর’ নামেই উল্লেখ করেন।
সুতরাং দুই ফরমের ব্যবস্থা করায় ব্যবসাটি উপরোক্ত হাদীসের নিষেধাজ্ঞা থেকে বের হয়ে যায় নি, বরং যথারীতি আগের অবস্থাতেই বহাল আছে যা শরী‘আতে নিষিদ্ধ।
(গ) হাসিল হওয়া না-হওয়ার অনিশ্চয়তা (الغرر) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং অবৈধ হওয়ার আরো একটি কারণ হলো তাতে হাদীসে নিষিদ্ধ الغرر (হাসিল হওয়া না-হওয়ার অনিশ্চয়তা) রয়েছে। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন,
«نَهَى رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- عَنْ بَيْعِ الْحَصَاةِ وَعَنْ بَيْعِ الْغَرَرِ»রাসূলুল্লাহ স. নুড়ি পাথর নিক্ষেপ করে ক্রয়-বিক্রয় সাব্যস্ত করা এবং বাইয়ুল গারার (অনিশ্চিত ক্রয়-বিক্রয় করা) থেকে বারণ করেছেন। [সহীহ মুসলিম : ৩৮৮১]
বাইয়ুল গারারের সংজ্ঞা :
ইসলামি পণ্ডিতগণ বাইয়ুল গারার -এর সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে প্রদান করেছেন। নিম্নে তা প্রদত্ত হলো :
(ক) আল্লামা কাসানী রাহ. বলেন, ‘‘গারার হচ্ছে এমন একটি অনিশ্চয়তা, যাতে হওয়া এবং না-হওয়া উভয় দিক বিদ্যমান।’’ [বাদায়ে‘উস সানায়ে‘উ, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৩৬৬]
(খ) আল্লামা ইবনুল আসীর জাযারী রাহ. বলেন, ‘‘যার এমন একটি প্রকাশ্য রূপ রয়েছে যা দ্বারা মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হয়; কিন্তু এমন অদৃশ্য কারণ রয়েছে যে কারণে তা অস্পষ্ট। এর প্রকাশ্য রূপ ক্রেতাকে ধোঁকায় ফেলে। আর এর ভিতরের রূপ অজানা’’ [জামেউল উসূল, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৫২৭]
(গ) আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন, ‘‘বাইয়ুল গারার ঐ কারবারকে বলা হয় যাতে পণ্য বা সেবা পাওয়া যাবে কিনা তা অনিশ্চিত অথবা চুক্তিভুক্ত ব্যক্তি নিজে তা যোগান দিতে অক্ষম অথবা যারা পরিণাম অজানা’’ [যাদুল মা‘আদ, খণ্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ৭২৫]।
(ঘ) কারো কারো মতে, বাইয়ুল গারার হলো, ‘‘যে কোনো কারবারের চুক্তির মধ্যে অনিশ্চয়তা।’’ যেমন, পুকুরে বা নদীতে মাছ কেনা-বেচা, আকাশে উড়ন্ত পাখি বেচা-কেনা ইত্যাদি।
মোটকথা, যাতে হাসিল হওয়া বা না-হওয়ার অনিশ্চয়তা রয়েছে তাই হচ্ছে আল-গারার। হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী যে ব্যবসায় এ গারার পাওয়া যাবে তা অবৈধ ও নাজায়িয। আল্লামা ইবন কুদামাহ তার ‘আশ-শারহুল কাবীর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইবরাহীম হারবীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, কোনো লোক যদি এ শর্তে মোরগ ভাড়া নিতে চায় যে, এ মোরগ তাকে সালাতের সময় ঘুম থেকে জাগাবে তবে এ ধরনের কারবার জায়িয হবে কি না? তিনি উত্তর দিলেন, না। কারণ এটি অনিশ্চিত কারবার। হতে পারে কখনো কখনো মোরগ ডাকবে না, আবার কখনো সালাতের সময়ের আগে ডাকবে বা পরে ডাকবে, আবার কখনো হয়তো তার মুখ থেকে ডাক বের করার জন্য প্রহারের প্রয়োজন হবে ইত্যাদি। সুতরাং নানাবিদ অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা থাকায় এ ধরনের চুক্তি জায়িয নেই। [খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ৩১৯]
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানির পদ্ধতির দিকে তাকালে অনুমেয় হয় যে, সেখানে বহু পদ্ধতিতে গারারের উপস্থিতি রয়েছে। একজন ডিস্ট্রিবিউটর যে চুক্তিতে কোম্পানির সাথে যুক্ত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো, লোকটি তার ডাউনলাইন থেকে কমিশন লাভ করতে থাকবে। অথচ তার নিজের বানানো দু’জন ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের বিষয়টি সম্পূর্ণই অনিশ্চিত এবং অন্যের কাজের ওপর নির্ভরশীল। কারণ তার নিম্নের নেটগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অগ্রসর না করলে লোকটি কমিশন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে; যে কমিশনকে কেন্দ্র করেই সে মূলত এ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়েছে।
কোনো কোনো মাল্টি লেভেল কোম্পানিতে ‘ট্রি প্লান্টেশন’ নামে একটি পদ্ধতি রয়েছে। বছরখানেক আগে এ প্রতারণা নিয়ে পত্রিকায় ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। ৮০০০ (আট হাজার) টাকা নিয়ে ১২ বছর পর ৩০,০০০ (ত্রিশ হাজার) টাকা অথবা সমপরিমাণ অর্থের গাছ প্রদানের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করা হয়। গাছ লাগানোর জন্য আদৌ কোনো জায়গা ক্রয়া করা হয়েছে কি না বা কতজন গাছ লাগানোর জন্য টাকা দিয়েছে— এসব বিষয়ে একটা অস্পষ্টতা থেকেই যাচ্ছে। এ সকল অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতার কারণে ইসলামি শরী‘আত এ লেনদেনকে বৈধ সাব্যস্ত করে না।
(ঘ) সুদের সাদৃশ্য ও দৃঢ় সন্দেহ (شبهة الربا) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং হালাল না হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, এতে শরী‘আত নিষিদ্ধ সুদের সাদৃশ্য ও সন্দেহ বিদ্যমান। ইসলামি আইন অনুযায়ী যে সকল কারবারে সুদের সাদৃশ্য ও সন্দেহ রয়েছে তা না জায়িয। ইসলামি আইনবিদগণ এ কারণে বহু কারবারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কারণ রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন,
«الْحَلالُ بَيِّنٌ وَالْحَرَامُ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ ، فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ»‘‘হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট। এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে সন্দেহ ও সাদৃশ্য বিষয় যা অধিকাংশ মানুষই জানে না। কাজেই যে সাদৃশ্য ও সন্দেহ থেকে বেঁচে থাকে সে নিজের দ্বীন ও ইজ্জত রক্ষা করল। আর তাতে জড়ালো সে হারামে নিপতিত হলো’’ [সহীহ বুখারী : ৫২]।
অপর এক হাদীসে এসেছে,
«دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلَى مَالا يَرِيبُكَ»‘‘তোমাকে যা সন্দেহে ফেলে তা ছেড়ে তুমি নিশ্চিত জিনিসের দিকে ধাবিত হও।’’ [সুনান তিরমিযী : ২৫১৮, হাদীসটি সহীহ]
ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,
إِنَّ آخِرَ مَا نَزَلَ مِنْ الْقُرْآنِ آيَةُ الرِّبَا وَإِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُبِضَ وَلَمْ يُفَسِّرْهَا فَدَعُوا الرِّبَا وَالرِّيبَةَ‘‘কুরআনের সর্বশেষ আয়াত হচ্ছে রিবা (সুদ)-এর আয়াত। রাসূলুল্লাহ স.-এর মৃত্যু হয়ে গিয়েছে কিন্তু তিনি সুদের আয়াতের ব্যাখ্যা দেন নি। কাজেই তোমরা সুদ এবং এমন জিনিস যাতে সুদের সন্দেহ রয়েছে তা বর্জন করো’’ [মিশকাত : ২৮৩০, সুনান ইবন মাজাহ : ২৪৭, হাদীসটি সহীহ]।
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘোষণা হলো, যেহেতু রাসূলুল্লাহ স. রিবার আয়াতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে যান নি সেহেতু যাতে সরাসরি রিবা রয়েছে তাতো বর্জন করতেই হবে পাশাপাশি যাতে রিবার সন্দেহ ও সাদৃশ্য রয়েছে তাও বর্জন করতে হবে।
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ সুদের সাদৃশ্য-এর বিবরণ এভাবে দেয়া যায় যে, এসব কোম্পানিগুলোতে ডিস্ট্রিবিউটররা পণ্য ক্রয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ হয় কমিশন পাওয়ার আশায়। এতে বুঝা যায়, সে পণ্য ক্রয় বাবদ যে টাকাটি দিয়েছে তা শুধু ঐ পণ্যের মূল্য হিসেবেই দেইনি বরং তা দেয়ার পেছনে তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ডাউনলাইনদের কাছ থেকে কমিশন ভোগ করা। পণ্যের মূল্য প্রদানের পাশাপশি কমিশনের যে সুযোগের আশায় সে এ কারবারটি করছে তাই ইসলামি শরী‘আতের পরিভাষায় সুদের সাদৃশ্য।
কারও নেট চলমান থাকার কারণে সে নির্দিষ্ট টাকার মোকাবেলায় কমিশন পাওয়ার বিষয়টি যেমনি সুদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ তেমনি যার নেট একেবারেই অগ্রসর হয় নি তার বিষয়টিও সুদের সাদৃশ্য থেকে মুক্ত নয়। কারণ সে তো টাকা দিয়েছিল পণ্য এবং ডিস্ট্রিবিউটর হয়ে কমিশন ভোগ করার জন্য। অথচ ডিস্ট্রিবিউটরের কোনো সুবিধাই সে পায় নি। তথা কিছু টাকা বিনিময়ের অতিরিক্ত থেকেই যাচ্ছে যা ইসলামি আইনের দৃষ্টিতে সুদের সাদৃশ্য বা সন্দেহমূলক সুদ।
আর তাছাড়া উপরে আমরা পদ্ধতিগত দিকের প্রথম যে কারণ ‘শ্রমবিহীন বিনিময় এবং বিনিময়বিহীন শ্রম’ উল্লেখ করেছি তাও ইসলামী শরী‘আতের দৃষ্টিতে সন্দেহমূলক সুদের আওতাভুক্ত। কারণ সেখানে শ্রম না দিয়ে বিনিময় নেয়াটি যেমন সুদ সাদৃশ্য তেমনি শ্রম নিয়ে বিনিময় না দেয়াটিও সুদ সাদৃশ্য।
(ঙ) জুয়ার সাদৃশ্য (شبهة الميسر) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যবসা না জায়িয হওয়ার আরও একটি কারণ হলো, এর সাথে জুয়ার সাদৃশ্য রয়েছে। ইসলামি পণ্ডিতগণ এ ব্যবসাকে জুয়ার সাথে তুলনা করে একে হারাম ফতোয়া দিয়েছেন। এ ব্যবসায় একজন ডিস্ট্রিবিউটর পণ্য ক্রয় করার পর সে যদি তার ডান ও বাম হাত উভয় দিকে সমান্তরাল ডিস্ট্রিবিউটর বাড়াতে পারে তবে সে কমিশন পাবে অন্যথায় সে কোনো কিছুই পাবে না। এটি জুয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর জুয়াকে ইসলামি আইন হারাম করেছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡخَمۡرُ وَٱلۡمَيۡسِرُ وَٱلۡأَنصَابُ وَٱلۡأَزۡلَٰمُ رِجۡسٞ مِّنۡ عَمَلِ ٱلشَّيۡطَٰنِ فَٱجۡتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٩٠﴾ [المائدة: 90]‘‘হে মু’মিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপুজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কার্য। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো— যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’’ [সূরা মায়িদা, আয়াত নম্বর : ৯০]।
ইন্টারন্যাশনাল ফিকহ একাডেমি কর্তৃক প্রদত্ত এক ফতোয়ায় মাল্টি লেভেল মার্কেটিংকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। তারা এ সিস্টেমে আপলাইনের দালালদের যে কমিশন দেয়া হয়া তা বৈধ দালালির ফি’র মতো নয় বলে জানান। বরং তারা প্রমাণ করেন যে, এতে সুস্পষ্ট জুয়াবাজী নিহিত রয়েছে।
(চ) বাতিল পন্থায় মানুষের মাল ভক্ষণ (أكل أموال الناس بالباطل) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং হালাল না হওয়ার আরো একটি অন্যতম কারণ হলো, এর মাধ্যমে ‘অন্যায়ভাবে অন্যের মাল ভক্ষণ’ করা হয় যা ইসলামি আইনে নিষিদ্ধ। এ ব্যবসায় আপলাইনের ডিস্ট্রিবিউটররা ডাউনলাইন ডিস্ট্রিবিউটরের বিক্রি থেকে ‘‘তত্ত্বাবধানের’’ নাম দিয়ে যে বিশাল কমিশন ভোগ করে, ইসলামি আইনের পণ্ডিতগণ সেটাকে ‘অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভোগ’-এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কারণ তাতে শ্রমবিহীন বিনিময় রয়েছে যা আমরা ইতোপূর্বের আলোচনায় সাব্যস্ত করে এসেছি। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ অন্যায়ভাবে অন্যের মাল ভক্ষণকে সম্পূর্ণভাবে হারাম করে ঘোষণা দিয়েছেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ إِلَّآ أَن تَكُونَ تِجَٰرَةً عَن تَرَاضٖ مِّنكُمۡۚ﴾ [النساء:29]‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা’’ [সূরা আন-নিসা : ২৯]।
বিখ্যাত মুফাসসির আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এবং প্রখ্যাত তাবিঈ হাসান বসরী রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘‘বিনিময়ের শর্তযুক্ত চুক্তিতে বিনিময়বিহীন উপার্জনই হল বাতিল পন্থায় উপার্জন’’ [আহকামুল কুরআন (জাসসাস) খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ১৭২]
মোটকথা: অত্র আয়াতে ‘‘অন্যায়ভাবে’’ বলতে এমন সব কারবারকে বুঝানো হয়েছে যা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষিদ্ধ করেছেন।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ উল্লেখ করেন, এখানে ‘‘অন্যায়ভাবে’’ বলতে ‘‘এমন সব পদ্ধতির কথা বুঝানো হয়েছে যা সত্য ও ন্যায়নীতি বিরোধী এবং নৈতিক দিক দিয়ে ও শরী‘আতের দৃষ্টিতে নাজায়িয’’ [সূরা আন-নিসা, আয়াত ২৯]
ওআইসি‘র ইন্টারন্যাশনাল ফিকহ একাডেমির চীফ স্কলার প্রফেসর ড. আব্দুস সাত্তার আবু গুদ্দাহ এ সংক্রান্ত তার ফতোয়ায় বিষয়টি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “…compound brokerage falls under the category of eating up another’s property unjustly and has an element of gambling in it. The main factor that contributes to this is the fact that compound brokerage automatically implies that a portion from the sales of the down line will be channeled to the up line.” [The Awakening, November 2008; http://theawakening.blogspot.com/2008]
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর কমিশন পদ্ধতিতে কিভাবে ‘‘জুয়াবাজী’’ ও ‘‘অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভোগ’’ জড়িয়ে আছে তার একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়ে শেখ সালীম আল-হিলালী বলেন, “This type of business is pure gambling because the purpose is to develop continuous network of people. With this network, large number of people at the bottom of the pyramid (down line) pays money to a few people at the top (up line). In this scheme, no new wealth is created; the only wealth gained by any participation is wealth lost by other participants. Each new member pays for the chance to profit from payment of others who might join later.” [The Awakening, November 2008; http://theawakening.blogspot.com/2008]
(ছ) Business Fraud বা প্রতারণা (الغش) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং হালাল না হওয়ার আরো একটি কারণ হলো, তাতে রয়েছে বড় ধরনের প্রতারণা। অর্থনীতির হিসাবে কোনো অবস্থাতেই তাদের এ ব্যবসায় এক মাসে ১০ বা ২০ শতাংশ লাভ হতে পারে না। তাই এ ধরনের লাভ দিতে হলে কাউকে না কাউকে ঠকাতে হবেই। ফলে শর্তের মারপ্যাঁচ বুঝে উঠার আগেই প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এক শ্রেণীর লোকেরা। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّي»‘‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়’’ [সহীহ মুসলিম : ১৯৫]।
গ্রাম পর্যায়ে সরেজমিনে তদন্ত করে দেখা গেছে এ সকল কোম্পানির অধিকাংশ ক্রেতাই আপলাইনের অগণিত মধ্যস্বত্বভোগীদের কমিশনের কথা জানে না। এ হিসেবে তো এটি সুস্পষ্ট প্রতারণার শামিল। পৃথিবীতে যত মাল্টি লেভেল ব্যবসা রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ সফল হয়েছে মিশিগানের ‘অ্যামওয়ে’ নামের এমএলএম কোম্পানি। সেখানে ১০ শতাংশ ডিস্ট্রিবিউটর লাভ বা সফলতার মুখ দেখেছে, বাকী ৯০ শতাংশ তাদের কস্টার্জিত অর্থ কোম্পানির ওই ১০শতাংশের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেরা প্রতারিত হয়েছে।
(জ) বর্ধিত মূল্যে বিক্রয় (البيع بالسعر الغالي) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং না জায়িয হওয়ার আরও একটি কারণ হলো, এ সকল কোম্পানি পণ্যের যথাযথ মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে তা বিক্রয় করে থাকে। আর এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয় যা শরী‘আত অসঙ্গত। আমরা জানি, ট্রাডিশনাল মার্কেটিং-এ একটি পণ্য উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছতে উৎপাদক + এজেন্ট + পাইকার + খুচরা বিক্রেতা + ভোক্তা ইত্যাদি কতিপয় মধ্যস্বত্বভোগী থাকে। কিন্তু মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ এসকল মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের বাদ দিয়ে তারা নিজেরাই ডাউনলাইন ও আপলাইন নাম দিয়ে শত সহস্র মধ্যস্বত্ত্বভোগী সৃষ্টি করে চলছে। এ বিপুল সংখ্যক মধ্যস্বত্বভোগীকে কমিশন দিতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই কোম্পানিকে বর্ধিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে হয়। তাই তারা প্রচলিত পণ্যদ্রব্য পরিহার করে এমন পণ্য মার্কেটে নিয়ে আসে যেগুলো সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘‘নাইজেলা’’ নামক তৈল যার প্যাকেজ মূল্য ৬০০০ টাকা। মাত্র এ ৬০০০ টাকায় কোম্পানি ২৭৭৫ টাকা লাভ করে বলে স্বীকার করা হয়। এভাবে অন্যান্য পণ্যগুলোও দ্বিগুন বা তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হয়।
ইসলামি শরী‘আতে ক্রয়-বিক্রয় ও যাবতীয় চুক্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার প্রতি জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। ইসলামি আইনে পণ্যের গুণগত মান ও ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রিত হবে। ভিন্ন কোনো পদ্ধতিতে বাজার প্রভাবিত করা শরী‘আতে নিষিদ্ধ। সুতরাং পণ্যের মান বৃদ্ধি না করে কোনো কৌশল অবলম্বন করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করাকে ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না। যে সব কৌশলের মাধ্যমে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করা হয় তার প্রতিটিই ইসলাম হারাম করেছে। যেমন দাম বাড়ানোর জন্য দ্রব্য মজুত করা। যারা এরূপ করে ইসলামের পরিভাষায় তারা অভিশপ্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنِ احْتَكَرَ فَهُوَ خَاطِئٌ»‘‘যে ব্যক্তি বর্ধিত মূল্যে বিক্রির উদ্দেশ্যে পণ্য আটকে রাখে সে গুনাহগার’’ [সহীহ মুসলিম : ২১৬৪]।
অনুরূপ কৌশলে শহরের বাইরে থেকে আগত লোকদের থেকে অল্প মূল্যে মাল ক্রয় করে তা বেশি দামে বিক্রি করা হলে তা থেকেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিরত থাকতে বলেছেন। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
أَنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- «نَهَى أَنْ يَبِيعَ حَاضِرٌ لِبَادٍ»‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহরে বসবাসকারী কোনো ব্যক্তি শহরের বাইরে থেকে আগত কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পণ্য কিনে তা শহরের বাসিন্দাদের কাছে বিক্রি করা থেকে বারণ করেছেন’’ [সহীহ মুসলিম: ৩৫২৪]
এ নিষেধাজ্ঞার ফলে শহরে বসবাসরত মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের অল্প পরিশ্রমে অধিক মুনাফা লাভের বিষয়টি বন্ধ হয়ে গেলে তারা একটু বেশি পরিশ্রম দেখানোর জন্য আগে-ভাগে শহরের বাইরে গিয়ে পথিমধ্যে বিক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করে তা শহরে এনে বেশি দামে বিক্রয় করার কৌশল অবলম্বন করলে সে ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- «نَهَى عَنِ التَّلَقِّى لِلرُّكْبَانِ»‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহরবাসীকে শহরমুখী ব্যবসায়ীদের সাথে সাক্ষাৎ করে পণ্য ক্রয় করে তা শহরে এনে বেশি দামে বিক্রয় করতে বারণ করেছেন’’ [সহীহ মুসলিম : ৩৮৯১]
সুতরাং এটি সুস্পষ্ট যে, ইসলামি আইন দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি গুরুত্বসহ নিয়েছে। কোনো প্রকার কৌশল অবলম্বন বা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা শরীআত সঙ্গত নয়। বৃহৎ অর্থনীতির অনিবার্য ক্ষেত্রসমূহে কিছু নিয়ন্ত্রিত মধ্যস্বত্বভোগীর অনুমতি দিলেও ভোক্তা ও উৎপাদকের মাঝে অনর্থক মধ্যস্বত্ত্বভোগীর সংখ্যা বাড়ানো ইসলামে নিষিদ্ধ।
(ঝ) ইজারা চুক্তির উসূলের পরিপন্থী (خلاف أصول عقد الإجارة) : এমএলএম অবৈধ হওয়ার আরও একটি কারণ হলো তাদের কোনো কোনো পদ্ধতি ইজারা চুক্তির মূলনীতির পরিপন্থী। আমরা জানি, এ সকল কোম্পানিগুলোর ব্যাখ্যা অনুযায়ী ডিস্ট্রিবিউটরশিপ চুক্তিটি শরী‘আতের দৃষ্টিতে ‘আকদুল ইজারাহ।’ আর ‘আকদুল ইজারাহ’-এর দু’টি মৌলিক দিক রয়েছে। ১. শ্রম বা সেবা, ২. পারিশ্রমিক বা বিনিময়। আকদুল ইজারাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য এ দু’টি শর্ত বিদ্যমান থাকতেই হয়। কিন্তু কোনো কারবারে যদি এ দু’টির কোনো একটি না থাকে তথা সেবা বা শ্রম পাওয়া গেল কিন্তু বিনিময় পাওয়া গেল না কিংবা সেবা বা শ্রম ছাড়াই বিনিময় পাওয়া গেল তবে সে কারবারটি ইসলামি আইনে বৈধ নয়।
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ যেহেতু দুটোরই সম্ভাবনাই রয়েছে সেহেতু এ কারবার ও ব্যবসা হালাল নয়।
আরও কতিপয় ত্রুটি :
প্রাগুক্ত আলোচনায় আমরা শরী‘আতের নীতিমালার সাথে অসংগতিপূর্ণ বিষয়গুলোকে বিশেষভাবে পর্যালোচনা করেছি। নিম্নে তাদের আরো কতিপয় ত্রুটি তুলে ধরছি :
(ক) আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার স্বপ্ন : দারিদ্র পীড়িত ও বেকারত্বের এ দেশে অনেকেই বাকপটু পরিবেশকের কথার মারপেঁচে পড়ে অথবা সেমিনার দেখে কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও পণ্য ক্রয় করে পরিবেশক হয়ে যায়। পরবর্তীতে দেখা যায়, সে কোনক্রমেই অন্য কোনো ক্রেতা যোগাড় করতে পারে না। ফলে তার ধনী হওয়ার স্বপ্ন রূপান্তরিত হয় দুঃস্বপ্নে।
(খ) অন্যের ওপর চাপ সৃষ্টি : কখনো কখনো দেখা যায়, কোনো কোনো পরিবেশক তার নেট অগ্রসর করানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ফলে সে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে কোম্পানির সাথে যুক্ত করতে জোর আবদার করে। আবার কখনো নিজ থেকে টাকা ঋণ দিয়ে তাদের জন্য পণ্য সরবরাহ করে থাকে। তাদের পীড়াপিড়ির কারণে অনেকের ইচ্ছ না থাকা সত্ত্বেও পণ্যটি কিনতে বাধ্য হয়।
(গ) মূল পেশায় দায়িত্বশীলতা হ্রাস পাওয়া : এমএলএম-এর মূল কাজ যেহেতু ক্রেতা জোগাড় করা তাই অন্যান্য চাকুরির পাশাপাশি এটি করা খুবই সহজ। ফলে দেখা যায়, অনেকেই এ কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করার কারণে পেশাগত কাজের ফাঁকে ফাঁকে বা অফিস সময়ের পর ক্রেতার খোঁজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে বাধ্য হয়। এতে একদিকে পেশাগত কাজে ফাঁকি দেয়া হয় অন্যদিকে পেশাগত কাজে তার উদ্যম ও কর্মতৎপরতার ভাটা পড়ে। যা একসময় জাতীয় বিপর্যয়ও হতে পারে।
এমএলএম-এর সমর্থকদের যুক্তি ও তা খণ্ডন :
যারা এ ব্যবসাকে বৈধ বলে তারা বহুস্তর সুবিধাকে জায়িয করার জন্য যে সকল যুক্তি প্রদান করে থাকে তার কিছু আমরা উপর্যুক্ত আলোচনায় অপনোদন করেছি। যেমন, দু’ফরমের ব্যবস্থা। নিম্নে তাদের আরও কিছু যুক্তি তুলে ধরে সেগুলো খণ্ডন করা হলো :
প্রথম যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ সদকায়ে জারিয়ার ন্যায় :
এই কারবারের সমর্থকরা শ্রমের বহুস্তর সুবিধাকে সদকায়ে জারিয়ার সাথে তুলনা করে বলেন, ‘‘সদকায়ে জারিয়ায় ব্যক্তি যেমন একবার শ্রম দিয়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত এর ফল ভোগ করতে পারে তেমনি এখানে একজন একবার প্রত্যক্ষ শ্রম দিয়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তা ভোগ করার বৈধতা রাখে’’।
যুক্তি খণ্ডন : তাদের এ যুক্তির ৩টি উত্তর রয়েছে।
১. সদকায়ে জারিয়া একটি আধ্যাত্মিক বিষয় যার সাথে অর্থ ও শ্রম নীতির কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ সদকায়ে জারিয়ায় ব্যক্তি যেই ফল পায় তা হলো ছাওয়াব যার কোনো আর্থিক মূল্য নেই। সুতরাং তাদের এ তুলনা বা কিয়াসটি যথাযথ হয় নি। নিরেট ছাওয়াবের বিষয়কে আর্থিক মূল্যের সাথে তুলনা না করাই নীতিগত বিষয়।
২. সদকায়ে জারিয়ার সাথে এমএলএম-এর তুলনা করতে হলে কোম্পানিগুলোকে ঘোষণা দিতে হবে যে, ‘‘প্রতিটি ব্যক্তি তার প্রত্যক্ষ শ্রমের ভিত্তিতে সে সরাসরি যার নিকট পণ্য বিক্রি করবে শুধু তার নিকট থেকে কমিশন পাবে। বাদবাকি যাদের ক্ষেত্রে তার প্রত্যক্ষ শ্রম নেই তাদের উপকার করার কারণে তাদের কাছ থেকে শুধু ছাওয়াবের আশা করবে।’’ তারা এরূপ ঘোষণা দিলে তাদের সাথে ইসলামও একমত।
৩. সদকায়ে জারিয়ার বিষয়টি শরী‘আত প্রণেতা কর্তৃক স্বীকৃত এবং এর ছাওয়াব তিনি নিজ ভাণ্ডার থেকে দেন। এতে অন্য কারো ক্ষতি হচ্ছে না। কিন্তু এমএলএম কোম্পানিগুলো কমিশনটি নিজেদের তহবিল বা ভাণ্ডার থেকে দেয় না বরং তা নতুন ক্রেতার নিকট কমদামি পণ্যটি চড়া দামে বিক্রি করার মাধ্যমে বর্ধিত মূল্যের একটি অংশকে কেটে কেটে প্রদান করে। কাজেই সদকায়ে জারিয়ার সাথে এর তুলনা অমূলক।
দ্বিতীয় যুক্ত : ডাউনলাইনের লোকদের পেছনে আপলাইনের লোকদের কোনো না কোনো শ্রম থাকে ঃ
তারা বলে, ‘‘আপলাইনের লোককে তার নেট সম্প্রসারণের জন্য প্রচুর পরিমানে খাটতে হয়। সে ঘরে বসে থাকলে তার নেট অগ্রসর হতো না’’ অথবা ‘‘যেহেতু আপলাইনের লোকের সরাসরি প্রচেষ্টায় দু’জন লোক যুক্ত হয়েছে এবং তাদের মাধ্যমে আরো দু’জন, এভাবে নেট সম্প্রসারিত হয়েছে। কাজেই ধরে নেয়া যায় যে, সকল ক্ষেত্রেই তার শ্রম রয়েছে’’।
যুক্তির খণ্ডন : ইসলামি শরী‘আতের আইন মতে তাদের এ যুক্তিটি বাতিল যুক্তি। কারণ শরী‘আতের দৃষ্টিতে কোনো কারবার বৈধ-অবৈধ হওয়ার ভিত্তি হচ্ছে এর চুক্তিনামার শর্তাবলি। অর্থাৎ কোনো চুক্তিতে শরী‘আত নিষিদ্ধ ধারা উল্লেখ থাকলে তা অবৈধ বলে গণ্য হবে। যেহেতু এমএলএম আইন অনুযায়ী অধীনস্থ নেট সম্প্রসারণে উপরস্থ ব্যক্তির শ্রম থাকুক বা না থাকুক নেট চালু থাকলে প্রত্যেকেই চুক্তি অনুযায়ী কমিশন লাভ করবে সেহেতু এ চুক্তিটিই শরী‘আত সম্মত হয় নি। আর তাদের দ্বিতীয় বাণী, ‘‘ধরে নেয়া যায় যে, সকল ক্ষেত্রেই তাদের শ্রম রয়েছে’’ এটি ভিত্তিহীন। কারণ আপলেভেলে দু’ব্যক্তিকে যুক্ত করার কারণে ডাউনলেভেলের সকলের অন্তর্ভুক্তিতে তার শ্রম রয়েছে- এমন কথা সুস্থ বিবেক মেনে নিতে পারে না।
তৃতীয় যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ বইয়ের প্রচার স্বত্ত্বের মতো ঃ
তারা বলে, একজন লেখক তার বইয়ের প্রতি সংস্করণের জন্য প্রকাশক থেকে টাকা পেয়ে থাকে, এমএলএম-এর কমিশনও সে ধরনের কিছু।
যুক্তির খণ্ডন : বইয়ের প্রচার স্বত্বের সাথে এর তুলনা অবান্তর। কারণ বই যতই বের হোক, তাতে তো লেখকের চিন্তা থেকে বের হওয়া খাটুনিমাখা লেখাই থাকছে। একটি বইয়ের মূল উপাদান তো আর কাগজ-কালি নয়; বরং এর ভেতরের জ্ঞানই এর মূল সম্পদ। অথচ এমএলএম-এর কমিশন কার সম্পদ?
চতুর্থ যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ পুত্রের আয়ে পিতার হক ও অংশের মতো ঃ
তারা বলে, কোনো পিতা যেমনিভাবে তার পুত্রের পেছনে বিনিয়োগ ও তত্ত্বাবধানের কারণে পুত্রের আয়ে বৈধ হক রাখে তেমনিভাবে এমএলএম-এ আপলাইন ‘তত্ত্বাবধানের’ দায়িত্ব নিয়ে ডাউনলাইনের আয়ে বৈধ হক রাখে।
যুক্তির খণ্ডন : তাদের এ যুক্তিটি একাধিক কারণে সঠিক নয়। যথা :
১. পুত্রের আয়ে পিতার বৈধ হকের বিষয়টি পুত্রের ওপর পিতার বিনিয়োগ ও তত্ত্বাবধানের কারণে নয় বরং তা শরী‘আত প্রণেতার মিরাছ আইনের কারণে। তা বিনিয়োগ ও তত্ত্বাবধানের সাথে সম্পৃক্ত নয়। তা হলে কন্যার আয়েও পিতার বৈধ হক থাকত। কারণ সেখানেও বিনিয়োগ ও তত্ত্বাবধানের বিষয়টি রয়েছে।
২. পুত্রের আয়ে পিতার হকের কোনো মাল্টি-লেভেল প্রভাব নেই। পুত্র কাউকে কাজে লাগালে সেখান থেকে পিতা কোনো সুবিধা পাওয়ার হক রাখে না। আবার পিতা একই সময়ে একাধিক লেভেল যেমন পুত্র, পৌত্র ও প্রপৌত্র থেকে আথির্ক সুবিধা দাবি করতে পারে না যেমনটা এমএলএম-এ করা হয়।
পঞ্চম যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ অনাথ শিশুকে কর্মক্ষম করলে তার উপার্জনে প্রাপ্য অংশের ন্যায় :
তারা বলে, একটি অনাথ শিশুর পিছনে বিনিয়োগ ও শ্রম দিয়ে তাকে শিক্ষিত ও কর্মক্ষম করে তুললে তার উপার্জনে উক্ত অভিভাবকের যেমনিভাবে একটি বৈধ অংশ সৃষ্টি হয় তেমনিভাবে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ একজন প্রতিনিধি প্রত্যক্ষ শ্রম দিয়ে কোনো নতুন ব্যক্তিকে এর অন্তর্ভুক্ত করলে তার ভবিষ্যৎ নিম্নলেভেলের চুক্তিসমূহের মধ্যেও প্রতিনিধির একটি বৈধ অংশ সৃষ্টি হয়ে যায়।
যুক্তির খণ্ডন : তাদের এ যুক্তিতে যদিও যথেষ্ট বিচক্ষণতা রয়েছে তথাপি তাদের এ যুক্তিটি মাল্টি লেভেলের সুবিধাকে সমর্থন করে না। কারণ এ ক্ষেত্রে যে তার পিছনে বিনিয়োগ করল সে একদিকে পাবে ছাওয়াব যার আর্থিক মূল্য নেই অন্যদিকে সে যে অর্থ বিনিয়োগ করেছিল তা পাওয়ার অধিকার রাখলেও সেটার সাথে বহুস্তর পর্যন্ত সুবিধা ভোগের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ এ ক্ষেত্রে অনাথের পেছনে বিনিয়োগকারী শুধুমাত্র তার বিনিয়োগকৃত টাকারই হকদার। এর অতিরিক্ত কোনো কিছুর সে হকদার নয়।
ষষ্ঠ যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ বাড়ি ভাড়া ভোগের মতো :
তারা বলে, ‘‘একবার শ্রম ও বিনিয়োগ করে বাড়ির মালিকরা সারাজীবন বসে বসে ঐ বাড়ির ভাড়া ভোগ করার যেমন বৈধতা রয়েছে তেমনি এমএলএম-এ একবার শ্রম দিয়ে ডাউনলাইন তৈরি করে তা থেকে কমিশন ভোগ করার বৈধতাও রয়েছে। কারণ, নীতি সব স্থানে একই রকম হওয়া উচিত’’।
যুক্তির খণ্ডন : এ যুক্তিতে তাদের মারপেঁচে তারাই ধরা খায়। কারণ একটি বাড়ি করার পেছনে দু’ধরনের বিনিয়োগ থাকে। মালিকের অর্থ ও শ্রমিকের শ্রম। যদি শ্রমের বহুস্তর সুবিধাকে মেনে নেয়া হয় তাহলে প্রতিটি বাড়ির ওপর শ্রমিকেরও সুবিধা ভোগের একটি স্থায়ী অধিকার অর্জিত হতো। কিন্তু বাস্তবে তো শ্রমিক সে বাড়ির কোনো সুবিধা ভোগ করে না। কারণ এক্ষেত্রে মালিক অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে বাড়ি অর্জন করেছে যা ভাড়া দেয়ার যোগ্য আর শ্রমিক শ্রম বিনিয়োগ করে টাকা অর্জন করেছে যা ভাড়া দেয়ার যোগ্য নয়। দু’পক্ষই দু’টি স্বতন্ত্র জিনিস অর্জন করেছে। এতে এটিই প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেকে তার শ্রমের একস্তর সুবিধা নিকটতম স্তর থেকেই পেয়ে থাকে; বহুস্তর থেকে নয়। বাড়ি, জমি, দোকান-পাঠ ইত্যাদি ভাড়া দিয়ে তা থেকে সুবিধা ভোগ করা যায়। কিন্তু তাতে বহুস্তর সুবিধা ভোগের কোনো বিষয় নেই। কিন্তু টাকা-পয়সা, খাদ্যদ্রব্য ধার বা ঋণ দিয়ে তা থেকে কোনো রকমের সুবিধা নেয়া সুস্পষ্ট সুদ।
সপ্তম যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ মালিক বসে থেকে শ্রমিকদের দ্বারা মুনাফা লাভের মতো :
একজন মহাজন কয়েক বছর শ্রম দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে দোকানে বসে শ্রমিকের দ্বারা তা বিক্রি করিয়ে বসে বসে টাকা গুনে। এটা যদি বৈধ হয় তবে এমএলএম-এ বহুস্তর সুবিধা বৈধ হবে না কেন?
যুক্তির খণ্ডন : অধিকার ও দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে দু’টি ব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্যের ফলে একটিকে অপরটির সাথে তুলনা করা সঠিক হয় নি। কারণ এরূপ ক্ষেত্রে কর্মচারীদেরকে নিয়োগ, বেতন-ভাতা ও আইনগত দায়-দায়িত্ব দেয়া মালিকের ওপর থাকে যা এমএলএম-এ নেই। তাছাড়া এ ক্ষেত্রেও শ্রমের বহুস্তরের সুবিধার বিষয়টি পাওয়া যায় না। কেননা, এ ক্ষেত্রে মহাজন তার নিযুক্ত কর্মচারীর বিক্রিত পণ্যের লাভ একবারই পাচ্ছে। মহাজনের দোকান থেকে যে ক্রয় করে অন্যের নিকট বিক্রয় করলো তার নিকট থেকে মহাজন কোনো কমিশন থাকছে না; আর পরের স্তরগুলোর কথা বাদই দিলাম।
অষ্টম যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ পেনশনের মতো ঃ
তারা বলে, ‘‘একজন কর্মীর জন্য তার চাকুরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোন প্রকার শ্রম ছাড়াই যেমন পেনশন গ্রহণ করা বৈধ তেমনি আমাদের এখানেও শ্রম ছাড়া বহুস্তর সুবিধা বৈধ’’।
যুক্তির খণ্ডন : বহুস্তরের সুবিধাকে পেনশনের সাথে তুলনা করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কারণ সরকার বা প্রাইভেট কোম্পানি একজন কর্মচারীর পেছনে যে খরচের হিসাব করে থাকে তার মধ্যে পেনশনও অন্তর্ভুক্ত থাকে। কাজেই পেনশন তা পারিশ্রমিকেরই একটি অংশ এবং আইনগত অধিকারও বটে। কিন্তু এমএলএম কোম্পানিতে নিম্নের নেটের জন্য প্রদেয় কমিশন কি তার প্রথম দু’জন ক্রেতা বানাবার পারিশ্রমিকের অংশ? যদি তাই হয় তবে তো নিম্নের নেট না চললেও সে তা পাবার অধিকার দাবি করতে পারে।
নবম যুক্তি : ‘বহুস্তর সুবিধা’ পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বৈধ :
তারা বলে, ‘‘ইসলাম ক্রেতা-বিক্রেতার পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসাকে বৈধ করেছে। আমাদের এ কারবারে পুরোপুরি পারস্পরিক সম্মতি রয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক লোকেরা স্বেচ্ছায় আমাদের সাথে চুক্তি করছে। কাজেই আমাদের এ কারবার বৈধ।
যুক্তির খণ্ডন : আমরা শুরুতেই ব্যবসায়িক কিছু নীতিমালা উল্লেখ করেছি। সেখানে এ নীতিমালার ক্ষেত্রে আমরা বলেছি যে, পারস্পরিক সম্মতিটি অবশ্যই হতে হবে কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বৈধ বিষয়ের ক্ষেত্রে। কুরআন ও হাদীস যা অবৈধ করেছে সে ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মতি থাকলেও তা বৈধ হবে না। দরিদ্র পীড়িত ও বেকারত্বের দেশে মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে সে সম্মতি নেয়া হয় কুরআনের এ সম্মতির অন্তর্ভুক্ত নয়। আল্লামা আসাদ বলেন, ‘‘ঈমানদারদেরকে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেতে নিষেধ করা হয়েছে; এমনকি অপর পক্ষ (দুর্বল হওয়ার কারণে) পরিস্থিতির চাপে বঞ্চনা ও শোষণমূলক চুক্তিতে সম্মতি দিলেও’’ [Asad: The Message of the Quran, pp 142-4]।
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং সম্পর্কে বিশিষ্ট পণ্ডিতগণের অভিমত :
বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই এ ব্যবসাটি প্রচলিত রয়েছে। তাই এর বৈধতা-অবৈধতা ও উপকার-অপকার নিয়ে বিশিষ্ট পণ্ডিতগণ বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। নিম্নে বিশেষ বিশেষ কতিপয় মন্তব্য প্রদত্ব হলো :
(ক) ইসলামী ফিকহ একাডেমি ১৭ জুন ২০০৩ সালে এর তৃতীয় অধিবেশনে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা হল : ‘‘বিজনাস কোম্পানি ও এর মত অন্য সকল মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের কোম্পানি সমূহের ব্যবসায় অংশগ্রহণ করা শরী‘আতে জায়েয হবে না।…..’’ লিংক:
(খ) সউদি আরবের উচ্চ ওলামা পরিষদ মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের ব্যাপারে নিম্নবর্ণিত অভিমত ব্যক্ত করেছেন :
‘‘পিরামিড স্কিমের উপর ভিত্তি করে যে ব্যবসা চলছে, যাকে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বলে অভিহিত করা হয়, তা হারাম। কেননা এ ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য হলো কোম্পানির নতুন সদস্য বানিয়ে কমিশন অর্জন, কোম্পানির উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় থেকে অর্জিত লাভ মূল উদ্দেশ্য নয়। যখন কমিশনের পরিমাণ পৌঁছে যায় দশ-হাজার (রিয়াল), একই সময় তখন উৎপাদিত পণ্যের মূল্য মাত্র কয়েক শত (রিয়াল)ও অতিক্রম করে না। যে কোন বুদ্ধিমান মানুষকে এ দুটোর কোনটা গ্রহণ করবে জিজ্ঞাসা করা হলে সে অবশ্যই কমিশন এখতিয়ার করবে।
এজন্যই এ কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের প্রচার ও মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে বিশাল কমিশন প্রাপ্তির বিষয়টি উপস্থাপন করে, যা অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা লাভ করবে এবং কাস্টমারদেরকে পণ্যের সামান্য মূল্যের মোকাবেলায় বড় ধরনের লাভ দেয়ার লোভ দেখায়। আর কোম্পানি যে পণ্যের মার্কেটিং করে বেড়ায়, সেটা শুধুই কমিশন লাভের একটা মাধ্যম মাত্র। কোম্পানির লেনদেনের এ বাস্তবতার কারণে এ ব্যবসাটি হারাম। হারাম হওয়ার কারণগুলো বিস্তারিতভাবে নিম্নরূপ :
১. এ ব্যবসায় দু’ প্রকার সুদই বিদ্যমান :-
ক. রিবা আল-ফাদল
খ. রিবা আন-নাসীআহ
কেননা গ্রাহক অল্প কিছু টাকা দিয়ে অনেক বেশি টাকা অর্জন করে থাকে। ফলে তা টাকার বিনিময়ে পরবর্তিতে অতিরিক্তসহ টাকা প্রদান হয়ে যাচ্ছে। আর এটাই হচ্ছে সে রিবা বা সুদ যা কুরআন, হাদীস ও ইজমা দ্বারা হারাম সাব্যস্ত হয়েছে। আর কোম্পানি কর্তৃক বিক্রীত পণ্য শুধু আড়াল ও মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা ক্রয় করা গ্রাহকের উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং পণ্য ক্রয় করা সত্ত্বেও এ লেনদেন বৈধ হবে না।
২. এটা এমন ‘গারার’ ও অশ্চিয়তামূলক লেনেদেনের অন্তর্ভুক্ত যা শরী‘আতে হারাম। কেননা গ্রাহক জানে না সে প্রয়েজনীয় সংখ্যক কাস্টমার যোগাড় করতে পারবে কি-না। আর পিরামিড বা নেটওয়ার্ক মার্কেটিং যতই চলতে থাকুক, তা কোন এক সময় অবশ্যই শেষ পর্যায়ে উপনীত হতে বাধ্য। আর গ্রাহক জানে না যে, সে কি পিরামিড স্কিমে সম্পৃক্ত হয়ে সবের্বাচ্চ স্তর পর্যন্ত পৌঁছে লাভবান হতে পারবে? নাকি সর্বনিম্ন স্তরে থেকে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে? অবশ্য প্রথম দিকের কিছু গ্রাহকই শুধু লাভবান হবেন, আর অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এটাই হচ্ছে অনিশ্চয়তামূলক লেনদেনের বাস্তবতা। আর তা হলো দুদিকের এ টানাটানি। তবে খারাপ ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লেনদেনের অনিশ্চয়তায় সম্পৃক্ত হতে নিষেধ করেছেন। [সহীহ মুসলিম]
৩. এ লেনদেনের মধ্যে রয়েছে কোম্পানি কর্তৃক মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ; কেননা কোম্পানি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে অন্যরা এ ধরনের চুক্তি থেকে লাভবান হয় না। অবশ্য কোম্পানি গ্রাহকদের কিছু সংখ্যককে লাভ প্রদান করে অন্যদেরকে প্রতারিত করার জন্য। এ বিষয়টিকে হারাম বলে কুরআনে ঘোষণা দেয়া হয়েছে,
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা বাতিল পন্থায় তোমাদের নিজেদের সম্পদ ভক্ষণ করো না।’’ [আন-নিসা : ২৯]
৪. এ লেনেদেনের মধ্যে রয়েছে প্রতারণা, অস্পষ্টতা ও মানুষকে সংশয়াচ্ছন্ন রাখা। যেমন এখানে পণ্য ক্রয় এমনভাবে দেখানো হয় যেন সেটাই এ লেনদেনের মূল উদ্দেশ্য। অথচ প্রকৃত অবস্থা এর বিপরীত। তদুপরি এখানে বড় ধরনের কমিশনের লোভ দেখানো হয়, যা অধিকাংশ সময়ই বাস্তবায়িত হয় না। আর এটাই হল সে প্রতারণা যা শরী‘আতে হারাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
‘‘যে আমাদেরকে প্রতারিত করল সে আমাদের অন্তর্ভূক্ত নয়।’’ [সহীহ মুসলিম]
তিনি আরো বলেছেন,
‘‘ক্রেতা-বিক্রেতা পৃথক না হওয়া পর্যন্ত তাদের এখতিয়ার থাকবে। যদি তারা সত্যবাদী হয় ও সবকিছু বিশদভাবে স্পষ্ট করে তাহলে তাদের বেচাকেনায় বরকত দেয়া হয়। আর যদি তারা মিথ্যা বলে ও গোপন করে তবে তাদের বেচাকেনার বরকত চলে যায়।’’ [সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম]
আর যে বলা হয়, এ লেনদেন হচ্ছে এক ধরনের দালালি, সে দাবি শুদ্ধ নয়। কারণ দালালি হচ্ছে এক ধরনের চুক্তি, যার ফলে পণ্য বেচাকেনা সম্পন্ন হলে দালাল তার পারিশ্রমিক পায়। অথচ নেটওয়ার্ক মার্কেটিংয়ের গ্রাহকই পণ্য বিক্রয়ের মূল্য পরিশোধ করে। তদুপরি দালালির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পণ্যের প্রকৃত মার্কেটিং, অথচ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং হল এর সম্পূর্ণ বিপরীত; কেননা এর মূল উদ্দেশ্য কমিশনের মার্কেটিং, পণ্যের নয়। এ কারণেই মাল্টি লেভেলের গ্রাহক চেষ্টা করে একের পর এক এ কমিশন বাণিজ্যের মার্কেটিংয়ের যা দালালির বিপরীত। কারণ দালাল এ ব্যক্তির কাছে মার্কেটিং করে যে প্রকৃতই পণ্য ক্রয় করতে চায়। ফলে উভয়ের পার্থক্য খুবই স্পষ্ট।
অনুরূপভাবে এ কমিশনকে হেবা বা অনুদান হিসেবে মনে করা যাবে না। আর যদি একে হেবা বা অনুদান বলে চালিয়ে দেয়া হয়, তবে মনে রাখতে হবে সকল হেবা শরী‘আতে জায়েয নেই। যেমন ঋণের উপর হেবা দেয়া-নেয়া সুদ বলে গণ্য। এজন্যই আবদুল্লাহ ইবন সালাম রা. আবু বুরদাহ রা.কে বলেছিলেন,
‘‘তুমি এমন যমীনে আছ, যেখানে সুদ প্রচলিত। যখন কোন ব্যক্তির কাছে তোমার কোন পাওনা থাকে< এরপর সে যদি তোমাকে এক বোঝা ঘাস, অথবা যব কিংবা এক বোঝা গো-খাদ্য প্রদান করে তাহলে তা হবে সুদ।’’ [সহীহ বুখারী]
যে উদ্দেশ্যে হেবা প্রদান করা হয় সে উদ্দেশ্যের শরয়ী বিধান কি হবে সে আলোকে হেবার হুকম নির্ধারিত হবে। এজন্যই যাকাত আদায়কারী কর্মচারী যে এসে বলেছিল, ‘এটা আপনাদের জন্য আর এটা আমাকে হাদিয়া দেয়া হয়েছে’, তার ব্যপারে নবী সা. বলেছেন,
‘‘তুমি কেন তোমার বাবা-মায়ের বাড়িতে বসে থাক নি? তাহলে দেখতে তোমাকে হাদিয়া দেয়া হয় কি-না!’’ [সহীহ বুখারী ও মুসলিম]
মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের এ কমিশন দেয়া হয় শুধুই নেটওয়ার্ক মার্কেটিংয়ের জন্য, একে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, চাই হাদিয়া বা হেবা কিংবা অন্য কোন নামে, তাতে এর প্রকৃত অবস্থা ও বিধানের কোন কিছুই পরিবর্তিত হবে না।…’’
গবেষণা ও ফাতওয়ার স্থায়ী কমিটি, সউদী আরব
সভাপতি :
শাইখ আবদুল আযীয আল-শাইখ
সদস্যবৃন্দ :
শাইখ সালেহ আল-ফাওযান
|
শাইখ আবদুল্লাহ আল-গুদাইয়ান
|
শাইখ আবদুল্লাহ আল-মুতলাক
|
শাইখ আবদুল্লাহ আর-রাকবান
|
শাইখ আহমাদ আল-মুবারাকী
|
[ফতওয়া নং- ২২৯৩৫; তাং ১৪-০৩-১৪২৫ হি.]
(গ) বিশিষ্ট লেখক, অধ্যাপক ও মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ রবার্ট লরেন্স ফিৎসপ্যাট্রিক এ ব্যবসার ওপর ১৪ বছর গবেষণা করেছেন এবং নিজেও কানাডার একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকেছেন। তিনি লিখেছেন,‘Its promoters would like you to believe that it is the wave of the future, a business model that is gaining momentum, growing in acceptance and legitimacy, and will eventually replace most other forms of marketing. Many people are led to believe that success will come to anyone who believes in the system and adheres to its methods. Unfortunately, the MLM business model is a hoax that is hidden beneath misleading slogans.’ অর্থাৎ ‘এর উদ্যোক্তারা চায় আপনি এ বিশ্বাস করবেন যে, এটা ভবিষ্যতের ধারা, একটা বিজনেস মডেল, যা গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে, এর আইনি যৌক্তিকতা বাড়ছে এবং অচিরেই এটি মার্কেটিংয়ের অন্য সব ধরনের স্থান দখল করে নেবে। অনেককে এটাও বিশ্বাস করানো হয় যে, যারা এ সিস্টেমের প্রতি আস্থা রাখে, সাফল্য তাদেরকেই ধরা দেবে। দূর্ভাগ্যক্রমে, এমএলএম বিজনেস মডেল হল একটি প্রতারণা যা লুকিয়ে আছে ভুল শ্লোগানের আড়ালে।’ [সূত্র : ইন্টারনেট] তার একটি বিখ্যাত প্রবন্ধ রয়েছে যার শিরোনাম ‘‘এমএলএম ব্যবসায় ১০টি বড় মিথ্যা’’।
(ঘ) ওয়াল্টার জে কার্ল ওয়েস্টার্ন জার্নাল অব কমিউনিকেশনে লিখেছেন ‘‘MLM organizations have been described by some as cults, pyramid schemes or organizations rife with misleading, deceptive, and unethical behavior, such as the questionable use of evangelical discourse to promote the business, and the exploitation of personal relationships for financial gain’’ [সূত্র : ইন্টারনেট]
(ঘ) মালেশিয়ার বিশিষ্ট পন্ডিত যাহারুদ্দীন আব্দুর রহমান এমএলএম-এর কমিশন ভোগকে হারাম গণ্য করে বলেন, “Generally, commission that is earned through sales of goods and services (like brokerage fee) is permissible in Islam. …However the commission in MLM and pyramid schemes may convert to haram status if (1) sales commission of the network is tied to his/her personal sale….” (2) Commission originates from an unknown down line because the network is too big. As a result, the upline seem to enjoy commission without the need to put any effort. This could be classified as compound brokerage (broker on broker on broker…) which falls under the category of eating up another’s property unjustly and has an element of gambling in it.” [www.zaharuddin.net]
উপসংহার:
সবশেষে আমরা এ কথা বলতে পারি যে, এ ব্যবসা শুধু শরী‘আতের সাথেই সাংঘর্ষিক নয় বরং স্বাভাবিক বুদ্ধি বিবেচনায়ও এটি অসংগতিপূর্ণ। মুখরোচক গল্প শুনিয়ে, ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে শর্তের বেড়াজালে আটকে এ ব্যবসার ধ্বজাধারীরা শত শত মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে, ছিনিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সরকার, মসজিদের ইমাম-খতীব, সমাজের নেতা, বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দায়িত্ব হল এ ব্যাপারে সমাজের লোকদের সচেতন করা। আল্লাহ আমাদের সকলকে এ ব্যবসার খপ্পরে পড়া থেকে রক্ষা করুন। আমীন!!
[1] এটি একটি প্রসিদ্ধ মত। এর বিপরীত মত হচ্ছে যে, যতক্ষণ শরী‘আতসম্মত না হবে, ততক্ষণ কোন কিছুই হালাল নয়। [সম্পাদক]
ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ -ই- গাফফার
প্রবন্ধ উৎসঃ ইসলামহাউজ ওয়েবসাইট
জি স্যার আপনি যে বলেছেন সবাই mlm বিজনেসে ঢুকার পর আর সদস্য পাওয়া যাবে না। আপনি এখন চাকরির বাজারের কথা চিন্তা করুন। বর্তমানে আসন সংখ্যা কম তবুও কিন্তু মানুষ চাকরি পাওয়ার জন্য বদ্ধ পরিকর। আপনার কথা অনুযায়ী এটাই প্রতিপন্ন হচ্ছে সবাই যখন চাকরি পেয়ে যাবে তখন আর কেও পাবে না।।
উত্তরমুছুনআপনি যে ভাবে জাহির করলেন তাতে মনে হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী আর পন্ডিত আপনি ই,আর কেউ কিছু জানে না,অন্যের মতামত নিয়ে ব্লগ বানানোই যায়,কিন্তু তাতে গ্রহন যোগ্যতা থাকে না,আর প্রায় অনেক বিষয় ই বাস্তবতা বিবর্জিত। আপনি নিজেই দেখেন না,আপনার লেখা টা কয়জন পড়েছে আর কয়জন দেখেছে,,,আপনার মত বহু জ্ঞানী রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে,,কারন তাদের চিন্তা ভাবনা নেগেটিভ আর অসত্য তথ্য দিয়ে তাদের জীবন গড়া।
মুছুন