বিজ্ঞাপন

Header ADS

২৪ জানুয়ারি, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান দিবসঃ ঐতিহাসিক এই দিনটিকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।

২৪ জানুয়ারি, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান দিবসঃ ঐতিহাসিক এই দিনটিকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।

তোফায়েল আহমেদঃ
বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি এক উজ্জ্বলতম দিন। এই দিনে সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান। সেদিন উত্তাল সংগ্রামের যে দাবানল জ্বলে উঠেছিল, তা কখনো মন থেকে মোছা যায় না। মতার মদমত্তে অহঙ্কারের পাহাড়ে বসে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান মনে করেছিল জনগণ বোবা দর্শক, আর তার মসনদ চিরস্থায়ী। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির মুক্তিসনদ ৬ দফা দেওয়ার কারণে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন বিুব্ধ বাংলার মানুষ দ্রোহের আগুনে জ্বলে ওঠে ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান-গণবিস্ফোরণের মুখে আইয়ুব খানকে মতার মসনদ থেকে বিদায় জানায় এবং ৩৩ মাস কারাগারে আটক প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনে। আমাদের ইতিহাসের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে রক্তে লেখা আত্মদান আর বিজয়ের গৌরবগাঁথা, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জেল-জুলুম আর নির্যাতন ভোগের তচিহ্ন। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিতে মোড়ানো জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস। একদিনে আমরা কোনো কিছুই অর্জন করিনি। রাতারাতি আকস্মিক ঘটনার মধ্যে আমাদের কোনো অর্জনও নেই। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নির্যাতিত জনসাধারণের শক্তিতেই আমাদের সব অর্জন। এ অর্জনের ইতিহাস দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস। রাজনৈতিক নেতৃত্বের জীবন ও যৌবনের ওপর নেমে আসা নির্যাতনের ইতিহাস। কত স্বজন, কত প্রিয় সহকর্মীর মুখ হারিয়েছি এ অর্জনের ইতিহাস নির্মাণে। কত মায়ের বুক খালি হয়েছে। ভাই হারানোর বেদনায় কত বোনের কান্না, সন্তান হারানোর বেদনায় কত মায়ের আর্তনাদ আর লাখ লাখ মানুষের রক্তের সিঁড়িপথেই আমরা অতিক্রম করেছি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের গৌরবময় অধ্যায়গুলো।
’৬৯-এর ২৪ জানুয়ারির ঝলমলে শীতের সকালটি আমাদের জীবনে অবিচল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার আগেই ুব্ধ জনতার উত্তাল সংগ্রামের মুখে গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। সেদিনের ঢাকার সংগ্রামের দৃশ্য ভাবতে কতই না ভালো লাগে। ’৬৯-র গণ-অভ্যুত্থান যে বীরত্বের ইতিহাস রচনা করেছিল, সে ইতিহাসের কঠিন শিাই হলো, জনগণের সংগ্রাম দাবানলের মতো জ্বলে উঠতে সময় লাগে না। জনতার ঐক্য যখন এক সুতায় গাঁথা হয়, তখন কোনো অপশক্তির ষড়যন্ত্র, অসত্য ও অসুন্দরের কালো পাহাড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। একজন স্বৈরশাসকের পতনের ইতিহাস যেমন করুণ, তেমনি জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই সত্য, চিরসুন্দর। আর তাই সত্যের জয় অনিবার্য।
১৭ জানুয়ারি দিনটি দুটি কারণে আমার জীবনে স্মরণীয়। ১৯৬৮-এর এই দিনে আমি ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হই। আর সেদিনই জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু আমাকে আশীর্বাদ করে অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়ে প্রত্যাশা করেছিলেন ডাকসু নেতৃত্বের সংগ্রামী ভবিষ্যৎ। বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই সেবারের ডাকসু ঐতিহাসিক ও সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিল। ডাকসুসহ ৪টি ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। ’৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুজিবের মুক্তি পর্যন্ত সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিল বাংলার ছাত্রসমাজ। আইয়ুবের লৌহ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে ’৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। সেই সংগ্রামের সাহসী সন্তানদের, আমার সহকর্মী-সহযোদ্ধাদের আজ তাই খুব বেশি মনে পড়ে। আমরা একসঙ্গে অভীষ্ট ল্য অর্জনের সংগ্রামে সফল হয়েছিলাম। আমরা বাংলার ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়েছিলাম।
আজ এই পরিণত বয়সে ’৬৯-এর সেই অগ্নিঝরা প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা কিংবা ইতিহাসের উত্তাল পল্টনের দিকে যখন ফিরে তাকাই, তখন রীতিমতো অবাক হই। ১৭ জানুয়ারি ৫ শতাধিক ছাত্রছাত্রী নিয়ে বটতলা থেকে যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, ১৮ জানুয়ারি সে সংগ্রামের স্রোতে সহস্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল- ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই।’ ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। সেদিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০ জানুয়ারি বটতলায় ছাত্রসমাবেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা। গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে হয় আমাদের। ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া হাজার হাজার ছাত্রের মিছিলে গুলিবর্ষিত হলে আসাদ নিহত হন। শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে তৈরি হয় পতাকা। এখনো বনানীর বাড়ির ড্রইংরুমে প্রবেশ করে সেই শার্ট দিয়ে তৈরি পতাকার ছবিতে যখন চোখ আটকে যায়, যেন নতুন সংগ্রামের উদ্দীপনা পাই। আন্দোলন-সংগ্রাম-ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বিজয় আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে আসাদের জানাজায় শোকে-ােভে উত্তাল জনসমুদ্র যেন এক শহীদের রক্ত ছাত্র-জনতার চেতনায় আগুন ছড়িয়েছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে আপসহীন সংগ্রামের শপথ নিতে এসেছে সবাই। মওলানা ভাসানীসহ সব জাতীয় নেতাও এসেছেন জানাজায়। ডাকসু ভিপি ও সংগ্রাম পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি। ২২ জানুয়ারি কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ জানুয়ারি মশাল মিছিল আর ২৪ জানুয়ারি ২টা পর্যন্ত হরতাল। ২২ জানুয়ারি ঢাকায় সব বাড়ি আর গাড়িতে কালো পতাকা উড়ল। সে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। শোক নয় যেন প্রতিবাদে জেগে উঠল নগরী। একটি মানুষও ঢাকায় দেখা গেল না যার বুকে শোকের চিহ্ন কালো ব্যাজ নেই। ২৩ জানুয়ারি ঢাকা নগরী মশাল মিছিলের নগরীতে পরিণত হলো, যেন প্রতিবাদের আগুনে জ্বলে উঠল ঢাকা। ২৪ জানুয়ারি হরতালে, সকাল থেকে ছাত্র-জনতা নেমে এল ঢাকায়। বিােভে উত্তাল রাজপথ। সচিবালয়ের পাশে আবদুল গণি রোডে মন্ত্রীর বাড়িতে আক্রমণ, পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনস্টিটিউটের ১০ম শ্রেণির ছাত্র মতিউরের সঙ্গে মকবুল, রুস্তম মিলে চারজন নিহত হয়। লাশ নিয়ে দুপুর ১২টার দিকে পল্টনে যাই। সর্বত্র এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে ঢাকার সব মানুষ যেন বিােভে নেমে আসে রাজপথে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলল ঢাকায়। দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন জ্বালানো হলো। এমএনএ এনএ লস্করের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাক্ষীদেও বাড়ি খুঁজতে থাকল জনতা। বিচারপতি এসএ রহমানের বাড়িতে আক্রমণ হলে তিনি লুঙ্গি পরে পালালেন। পল্টনে তিল ধারণের জায়গা নেই। মানুষ, মানুষ আর মানুষ। তারা গভর্নর হাউস আক্রমণ করতে চায়। বিনা মাইকে সেদিন পিনপতন নীরবতায় আমাকে বক্তৃতা করতে হয়। লাশসহ সবাইকে নিয়ে মিছিল করে আমরা ইকবাল হলের মাঠে চলে আসি। বিকাল ৩টার পর সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। মানুষ তা অমান্য করে বানের স্রোতের মতো নেমে আসে রাজপথে।
এদিকে ২০ জানুয়ারি আসাদের মৃত্যুর পর সংগ্রামে আসা ছাত্ররা পকেটে ঠিকানা লিখে নিয়ে আসত। এখনো ওই সংগ্রামের সাফল্য যেমন আনন্দ দেয়, মাথা উঁচু করে পথ চলতে প্রেরণা জোগায়, তেমনি মতিউরের পকেটে পাওয়া চিরকুটের কথা মনে পড়লে বুক ভারী হয়ে আসে। মতিউরের বুকপকেটে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল- ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি, তুমি মনে কোরো তোমার ছেলে বাংলার মানুষের জন্য জীবন দিয়ে গেছে। ইতি, মতিউর রহমান, ১০ম শ্রেণি, পিতা আজহার উদ্দিন মল্লিক, নবকুমার ইনস্টিটিউট। ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনি, মতিঝিল।’ সান্ধ্য আইনের মধ্যে মতিউরের লাশ তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলে যে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় তা হৃদয় দিয়ে শুধু অনুভব করা যায়, ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। মতিউরের মা বলেছিলেন, ‘আমার সন্তানের রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ ২০ জানুয়ারি শহীদ মিনারে আসাদের রক্ত ছুয়ে আমরা যে শপথ নিয়েছিলাম, ২৪ জানুয়ারি মতিউরের রক্তে সেই সংগ্রাম বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে। এদিকে ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থান ঘটলে ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বহাল থাকে। সান্ধ্য আইন প্রত্যাহারের পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে জনসভা। আমার জীবনে সেটিই পল্টনের প্রথম জনসভা। জনসভা নয়, যেন জনসমুদ্র। আমরা ১০ জন ছাত্রনেতা বক্তৃতা করি। সেদিনের শপথ দিবসের সভায় একটানা ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করে যখন ইতি টানি তখন সেøাগানে সেøাগানে জনসমুদ্রে ঢেউ উঠেছে ‘শপথ নিলাম, শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করবÑ শপথ নিলাম, শপথ নিলাম মাগো তোমায় মুক্ত করব।’ মনি সিংহ, তাজউদ্দীন আহমদ, শেখ ফজলুল হক মণি, আব্দুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেননসহ অনেকেই তখন কারাগারে। ছাত্র-জনতার বুকের আগুনে ১১ দফার আন্দোলন আর শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি এক হয়ে গেল। ছাত্র-জনতা মুজিবকে না নিয়ে ঘরে ফিরবে না। সভা শেষে সংগ্রামী জনতার ঢল ছুটল কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে। আজও সেসব স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিলকে সেদিন কারাগারের সামনে থেকে আমরা ফিরিয়ে এনেছিলাম।
এদিকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পল্টনে ‘ডাক’-এর আহ্বানে জনসভা। সেদিনই বঙ্গবন্ধু আমায় দেখতে চেয়ে কারাগারে ডাকেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্যান্টনমেন্টের কারাগারে আমাকে দেখা করাতে নিয়ে যান। মাজদা গাড়ি ড্রাইভ করেছিল শেখ কামাল। সেখানেই বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করেছিলেন। সেসব ভাবলে এখনো বুক ভরে যায়, দুচোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। কী উষ্ণ ভালোবাসাই না ছিল বঙ্গবন্ধুর হৃদয়পটজুড়ে। বিকালে ডাকের জনসভায় গেলে সভাপতি পদে নুরুল আমিনের নাম প্রস্তাব হলে জনতা প্রত্যাখ্যান করে। তখন আমাকে মঞ্চে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর ছবি বুকে লাগিয়ে বক্তৃতায় জনতার সমর্থন আদায় করে বলি, শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া গোলটেবিল নয়। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের নেতা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। নেতা ফিরে আসবেন, তাকে মুক্ত না করে আমরা ঘরে ফিরব না। ওই রাতেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক, ফজলুল হককে কারাগারে গুলি করা হয়। সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হন। প্রতিবাদে জনতা নেমে আসে রাজপথে। ১৫ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি আবার সান্ধ্য আইন জারি হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. শামসুজ্জোহা গুলিতে মারা যান। ২০ ফেব্রুয়ারি সান্ধ্য আইনের মধ্যে ঢাকা মশাল মিছিলের নগরী হয়ে উঠলে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের মহাসমুদ্র থেকে ঘোষণা করি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে। ভাবতে দারুণ ভালো লাগে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আমাদের আলটিমেটামের পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় বঙ্গবন্ধু ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিসহ সব রাজবন্দির মুক্তি দিতে সরকার বাধ্য হয়। লাখ লাখ জনতা তখন ছুটে গেল পল্টনে তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে দেখতে। কিন্তু শিা ভবনের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে আমরা ফিরিয়ে নিয়ে গেলাম ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে। পল্টনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ জনতাকে বললাম, ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতার সংবর্ধনা। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেন জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার। সভাপতিত্ব করলেও রীতিভঙ্গ করে নেতার আগেই বক্তৃতায় হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত হয় সত্যবচন- যে নেতা তার জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে। ফাঁসির মঞ্চে বাঙালির মুক্তির কথা বলেছেন, সে নেতাকে কৃতজ্ঞচিত্তে জাতির প থেকে একটি উপাধি দিতে চাই। ১০ লাখ লোক ২০ লাখ হাত উঁচিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল। কৃতজ্ঞচিত্তে শেখ মুজিবকে জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনজোয়ারই শুধু নয়, সমগ্র জাতি তখন আনন্দ আর কৃতজ্ঞতায় আবেগাপ্লুত হয়েছিল। পল্টনে শপথ গ্রহণের ১৪ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি এবং অপরাপর রাজনৈতিক নেতাদের আমরা মুক্ত করেছিলাম। দুই বছরের মাথায় প্রিয় নেতার নেতৃত্বে আমরা দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পেরিয়ে ’৭০-এর নির্বাচনের ঐতিহাসিক গণরায় নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছিলাম। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’- হৃদয় উজাড় করা সেøাগানে বাঙালি জাতি নেতার নির্দেশে এক স্রোতে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭১-এ নয় মাস রক্তয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা ধর্মীয় উন্মাদনার তথা সাম্প্রদায়িকতার কবর রচনা করেছিলাম।
আজ যখন স্মৃতিকথা লিখতে বসেছি, তখন বারবার মনে পড়ছে ’৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলনের অন্যতম প্রণেতা আব্দুর রউফ, সাইফুদ্দীন মানিক, ইব্রাহিম খলিলের কথা। মনে পড়ছে, মণি ভাই, রাজ্জাক ভাইসহ অসংখ্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর কথা। সিরাজ ভাই আজও বেঁচে আছেন। শারীরিক অবস্থা ভালোও না। আমি তার কাছে খুব ঋণী। কারণ ’৬৯-এ যখন মণি ভাই, রাজ্জাক ভাইসহ অন্য নেতারা কারাগারে ছিলেন তখন ছায়ার মতো কাছে রেখে সিরাজুল আলম খান আমাকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন। প্রতিটি কর্মসূচিতে তার অবদান ছিল। আমি সব সময় তার কথা মনে করি। আজ লিখতে বসে রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আমার স্মৃতিময় বহু ঘটনাই মনে পড়ে যাচ্ছে। রাজ্জাক ভাই আমাকে সঙ্গে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে ঘুরে কত শ্রম দিয়ে ছাত্রলীগকে গড়ে তুলেছেন। আমি একটি মোটরসাইকেল চালাতাম। আমার বাইকের পেছনে বসে তিনি কত জায়গায় যেতেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তিনি পরিশ্রম করেছেন ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার জন্য। পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতিতে তিনি অবদান রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অপরিসীম। সবার ভালোবাসার শ্রদ্ধার ছিলেন বলে মৃত্যুর পর জাতি তাকে জাতীয় বীরের মর্যাদায় সম্মানিত করে সমাহিত করেছে। গণমানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আমরা পেয়েছি। যখন ডাকসুর ভিপি ছিলাম, ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম, গণ-আন্দোলন সংগঠিত করতে আমরা যখন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যেতাম কী আদর-ভালোবাসা যে পেতাম মানুষের কাছ থেকে, তা আমি আজ লিখে-বলে বোঝাতে পারব না। হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ আমাদের একনজর দেখতে, একটিবার বুকে টেনে নিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। যখন কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যেতাম, সেখানে মানুষ ভিড় করত। আমার যখন লঞ্চে বাড়ি যেতাম, তখন যাত্রীরা আকুল আগ্রহে বলত, আমাদের জন্য কিছু কথা বলেন, আমরা আপনার কথা শুনব। রাজনৈতিক জীবনে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। কিন্তু রাজনীতির সূচনায় ছাত্রজীবনে আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করতে গণমানুষের কাছ থেকে আমি যে ভালোবাসা পেয়েছি, সেটি আমার জীবনের স্বর্ণযুগ। এ যুগ আর কোনোদিন ফিরে পাব না।
আসাদ-মতিউর-মকবুল-রুস্তম-সার্জেন্ট জহুরুল হক-ড. শামসুজ্জোহার রক্তে রঞ্জিত সেই ’৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলন। আজ যখন এই লেখা লিখছি তখন অতীতের অনেক স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে উঠছে। আমি কোথায় ছিলাম কোথায় এলাম। এক অখ্যাত পাড়াগাঁয়ে আমার জন্ম। যে পাড়াগাঁয়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হতো। রাস্তা-পুল-কালভার্ট-বিদ্যুৎ কিছুই ছিল না। আজ সেই পাড়াগাঁ শহরে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই অখ্যাত পাড়াগাঁয়ের একটি ছেলে আজ আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করে আমার দপ্তরে বসে এই লেখা লিখছি। সেদিন যারা আন্দোলন করতে গিয়ে হারিয়ে গেছে, আজ তারা বেঁচে থাকলে হয়তো আমার চেয়ে বড় নেতা হতে পারতেন। আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্নেহে ও আদর্শে আমি বড় হয়েছি। ছাত্রজীবন শেষে বঙ্গবন্ধু আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন। স্বাধীনতার পর মাত্র ২৯ বছর বয়সে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় আমাকে তার রাজনৈতিক সচিব করেছিলেন। ২৭ বছর বয়সে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য করেছেন। কত ঋণী আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে। বিশ্বের যেখানেই গিয়েছেন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছেন।  বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থেকে রাজনীতি করে আজ বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার শেখ হাসিনার সঙ্গে থেকে রাজনীতি করে চলেছি। তিনি জাতির জনকের স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে চান। আমি বিশ্বাস করি, আমরা সবাই যদি ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি, তাহলে আমরা এই বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে পারব।
’৬৯-এর মহান গণ-অভ্যুত্থান শিখিয়েছে, কীভাবে ভোটাধিকার আদায় ও সংরক্ষণ করতে হয় এবং যেনতেনপ্রকারে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয় বরং জনকল্যাণের জন্যই আমাদের রাজনীতি নিবেদিত। যারা তথাকথিত আন্দোলন-অবরোধের নামে প্রিয় দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণœ করতে মা-বোনের বুক খালি করছে, নিষ্পাপ শিশুকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করছে। আমি মনে করি, বাংলার মানুষ উপলব্ধি করেছে তারা আর যা-ই হোক রাজনীতিবিদ নয়। রাজনীতিবিদ কখনোই চলন্ত গাড়ির মধ্যে পেট্রলবোমা মারে না। রাজনীতি কখনোই এভাবে নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করে না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষের অধিকার আদায়ের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সংস্কৃতি। আমি বিশ্বাস করি বাংলার জাগ্রত মানুষ যেভাবে ’৭১-এ হাতিয়ার তুলে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে একদিন বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। সেই বাংলার মানুষ সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম হবে।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

তথ্য সংগ্রহঃ
  • বাংলা পত্রিকা - আমাদের সময়
  • অনলাইন নিউজ


ইতিহাসের এই দিনে ২৪ই জানুয়ারিঃ

ঘটনাবলিঃ
  • ১৮৪৮ - জেমস মার্শাল ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কাঠচেরাই কলে প্রথম সোনা আবিষ্কার করেন।
  • ১৯০৮ - ইংল্যান্ডে বয়স্কাউট আন্দোলনের সূচনা হয়। 
  • ১৯৫২ - বোম্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শুরু।
  • ১৯৮৪ - অ্যাপল ম্যাকিন্টশ বিক্রি শুরু হয়।

জন্মঃ
  • ১৯২৪ - সুভাষ ঘাই, ভারতীয় পরিচালক, পরিবেশক এবং চিত্রনাট্যকার।
  • ১৯৪৭ - মিশিও কাকু, একজন আমেরিকান পদার্থ বিজ্ঞানী।

মৃত্যুঃ
  • ১৮৭১ - ভিলহেল্ম ভাইৎলিং, জার্মান কারুশিল্পী এবং উনিশ শতকের বিপ্লবী।
  • ১৯৬৫ - উইন্‌স্টন চার্চিল, ইংরেজ রাজনীতিবিদ ও লেখক।
  • ১৯৬৫ - সাহিত্যরত্ন মুনশি আশরাফ হোসেন, বাঙালি কবি ও পুথি সংগ্রাহক।
  • ২০০৪ - লিওনিদাস, প্রাক্তন ব্রাজিলীয় ফুটবলার।
  • ২০০৬ - পিটার ল্যাডিফোগিড, ইংরেজ-মার্কিনী ভাষাবিজ্ঞানী।
  • ২০১৫ - আরাফাত রহমান কোকো ।


তথ্যসংগ্রহেঃ
লেখক ও প্রকাশক / অভয়া
Blogger দ্বারা পরিচালিত.